বিপ্লব কুমার পাল

তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল বিএনপির। তারা পেয়েছিল মাত্র ৩০টি আসন। ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে  কারচুপির অভিযোগ এনেছিল বিএনপি। অথচ বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের ইতিহাসে ২০০৮ সালের নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বীকৃতি পেয়েছিল। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করে। সংবিধান মেনে যথারীতি নির্বাচন হয়  এবং জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না যাওয়ার বিষয়ে অনড় থাকা বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই অংশ নেয়। বিএনপি পায় মাত্র পাঁচটি আসন৷ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে গোঁ ধরে আছে বিএনপি।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হয়েছে। সময় বাড়ানোর আর সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন ইসি সচিব। তবে রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। যে কোনো সময় বদলে যেতে পারে হিসাব-নিকাশ। যদি বিএনপি এবারের নির্বাচনে অংশ না নেয় তাহলে রাজনৈতিক দলের একমাত্র লক্ষ্য ‘ক্ষমতায় যাওয়া’ এবারও হবে না। তাহলে টানা ২৩ বছর বিএনপিকে ক্ষমতার বাইরে থাকতে হবে। এতো দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থেকে নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত রাখতে বিএনপিকে আরও পাঁচটি বছর কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে।

যদিও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা কর্মীদের আশ্বস্ত করে বলছেন, জোর করে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করলেও ক্ষমতায় টিকতে পারবেনা। আন্তর্জাতিক চাপে তারা পালাতে বাধ্য হবে। তাদের এই বক্তব্য নতুন নয়। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও বিএনপি নেতারা বলেছিলেন, বিএনপি অংশ না নিলে নির্বাচনই হবে না। যখনই নির্বাচন হয়ে গেলো, তখন তারা বললেন, সরকার গ্রহণযোগ্যতা পাবে না এবং শেষপর্যন্ত টিকতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগ শুধু টিকেই নেই, বিএনপিকেও নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করেছিল।

একই ভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়েও নানা কথা বলছে বিএনপি। কেন্দ্রীয় নেতারা বলেছিলেন, ১০ ডিসেম্বর সরকার পালিয়ে যাবে, খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলবে। ১০ ডিসেম্বর পর কিছু যখন হলো না, তখন তারা বললেন, খুব শিগগিরই সরকারের পতন হবে, গণঅভ্যুত্থান হবে। এরপর বিভিন্ন সময় দাবি আদায়ে দফা দিয়েছিল। কখনও ১০ দফা, কখনও ৩২ দফা, কখনও ১ দফা। কোনো আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা না পেয়ে তারা বললেন, ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নেবে।

গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের নামে নাশকতা করে বিএনপি। এঘটনায় বিএনপির অনেক নেতা এখন গ্রেপ্তার, অনেকে আবার আত্মগোপনে। এক মাস হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে নিজেদের অস্থিত্ব টিকিয়ে রেখেছে বিএনপি। প্রকাশ্যে আসেনি কোনো কেন্দ্রীয় নেতা। জেলায় পর্যায়ের নেতারাও মাঠে নামছে না। শুধু মামলার ভয়ে নয়, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপরও নাখোশ তারা।

তৃণমূলের নেতাদের অভিযোগ, বারবার ভুল কর্মসূচি দিয়ে দলের কর্মীদের শক্তি ক্ষয় করা হয়েছে। একমাস চুপচাপ থাকার পর আবারও ১০ ডিসেম্বরের আওয়াজ তুলতে শুরু করেছে তারা। বলছে, ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসবে। যেভাবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এসেছিল এলিট ফোর্স র‍্যাব ও এর কর্মকর্তাদের ওপর। বিএনপির ভবিষ্যত বাণী বারবার মিথ্যা প্রমানিত হয়েছে। কিন্তু তবুও তারা ওই পথ ছাড়েনি।

বারবার মিথ্যা বলে তা সত্য প্রমাণ করার চেষ্টা করছে বিএনপি। ঠিক যেন গোয়েবলসের মতো। মিথ্যাচার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইতিহাসের খলনায়ক হিটলার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি করেন বিশেষ মন্ত্রণালয়। নাম দেন ‘মিনিস্ট্রি অব পাবলিক এনলাইটেনমেন্ট অ্যান্ড প্রোপাগান্ডা’। আর এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন প্রিয়ভাজন গোয়েবলসকে। মানুষ যা কল্পনা করত না তা-ই বাস্তব বানিয়ে ছাড়তেন। এমন নিখুঁতভাবে করতেন সবকিছুই বিশ্বাসযোগ্য মনে বিএনপি যেন সেই হিটলারের পথে হাঁটছে। তাদের বক্তব্য বারবার মিথ্যা প্রমাণ হচ্ছে তবুও তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে সেই গুজবের পথই বেছে নিচ্ছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না, নিজেদের ক্ষতি তারা কীভাবে করছে। কথায় আছে- ‘অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়লে নিজেকেই সেই গর্তে পড়তে হয়।’ এখন বিএনপির অবস্থা হয়েছে তাই। অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তে নিজেরাই সেই গর্তে পড়ে গেছে।

২০১৪ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনীতি কৌশলের কাছে পেরে উঠছেনা বিএনপি। যার বড় প্রমান দেশবাসী দেখেছে ২৮ অক্টোবরের পর। আওয়ামী লীগ যখন শর্তহীন সংলাপের কথা বলেছিল, তখন বিএনপি শর্তযুক্ত সংলাপের বিষয়ে গোঁ ধরে রেখেছিল। যখন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস শর্তহীন সংলাপের আহবান জানালেন তখন সমর্থন দিল বিএনপি। কৌশলী আওয়ামী লীগ তখন জানালো- সংলাপের সময় শেষ হয়ে গেছে।

রাজনীতির মাঠে নাস্তানাবুত হওয়া বিএনপি যদি এবারের নির্বাচনে অংশ না নেয় তাহলে আগামী পাঁচ বছর অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে দলটিকে। কোনো আন্দোলনই জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে পারেনি দলটি। এখন তৃণমূলের কর্মীরাও বেজায় চটে আছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর।

গত কয়েক বছর ধরে বিএনপি কার্যকর নেতৃত্ব শূন্যতায় ভুগছে। জামায়াতপন্থীদের পরামর্শ গ্রহণ করায় অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা নিষ্ক্রিয়। বিএনপিতে সুবিধাবাদী একটি অংশের অবস্থান রয়েছে। তারা মনে করে রাজনীতি মানে কিছু প্রাপ্তি। ফলে দীর্ঘদিন সে প্রাপ্তি না থা থাকা এবং সরকারের চাপ – ইত্যাদি নানা কিছু মিলে বিএনপির সামনে একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনটা যদি হয়ে যায়, তাহলে কিছুই করার থাকবে না। কারণ ২০১৪ কিংবা ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরও তারা কিছু করতে পারেনি। এবারের নির্বাচনের পর কিছু করতে পারবে এমন বিশ্বাস আর নেই বিএনপির তৃণমূল নেতাদের।

রাজনৈতিক দলগুলোর কাঙ্খিত বিষয় হলো নির্বাচনে অংশ নেওয়া। বিএনপির অনেক নেতা মনে করেন- বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনটি মোটামুটি নিরপেক্ষ হয় তাহলে বহু বিএনপি নেতা জয়ী হবে। তাদের বিশ্বাস সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে আছে ভোটার। আর এই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারে বিএনপি। নির্বাচনে অংশ নিলে দেশের মানুষ ব্যালেটে নীরব বিপ্লব করবে। আর সেখান থেকেই ক্ষমতায় যেতে পারবে বিএনপি। তথ্য-প্রযুক্তির এই দিনে খুব বেশি কারচুপি করার সুযোগ নেই। তাছাড়া দেশ- বিদেশি পর্যবেক্ষক দল তো থাকবেই। তাই সরকার ইচ্ছে করলেও ভয়াবহ অনিয়ম করার সাহস পাবেনা।

বিএনপির অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা আছেন যারা পাঁচ বছর পর ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মতো শারীরিক অবস্থা থাকবেনা। তাদের জন্য ২০২৪ সালের ভোটই জীবনের শেষ সুযোগ। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বর্তমান বয়স ৭৫ বছর। ২০২৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তার বয়স দাঁড়াবে ৮১ বছর। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী তখন বয়স হবে ৭৯ বছর। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদের বর্তমান বয়স ৭৯ বছর। ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে তার বয়স দাঁড়াবে ৮৪ বছর। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বর্তমানে বয়স ৭৭ বছর, ২০২৯ সালের সংসদ নির্বাচনে তার বয়স দাঁড়াবে ৮২ বছর। ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের বর্তমান বয়স ৯২ বছর। আর ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার বয়স এখন ৮০ বছর। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের বয়স ৭৫ বছর, আগামী নির্বাচনের সময় তার বয়স হবে ৮০ বছর। ২০২৯ সালে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের সময় ড. আব্দুল মঈন খান বয়স হবে ৮২ বছর। আর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান ওমরের বয়স হবে ৮০।

বিএনপি যদি ভুল সিদ্ধান্তে নেয়, তাহলে এসব জ্যেষ্ঠ নেতাদের ফ্যালফ্যাল চোখে নির্বাচন দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। অনেক নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলেও লন্ডনের কড়া নির্দেশে মুখ খুলতে পারছে না। কারণ শেষ বয়সে এসে তারা ‘বিশ্বাসঘাতক’ তকমা নিতেও চান না।

বয়সের ভারে ন্যুব্জ শুধু কেন্দ্রীয় নেতারাই নয়, জেলা পর্যায়ের অনেক নেতার একই অবস্থা। তারা নেতৃত্ব শূন্য কর্মসূচির ভবিষ্যত দেখছেন না বহু নেতা। তাই ধানের শীষ ছেড়ে সতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন কেউ কেউ। আবার বিএনএফ, বিকল্পধারা ছাড়াও তৃণমূল বিএনপি এবং বিএনএম-এ যোগ দিয়েছেন বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতা এবং সংসদ সদস্য। এছাড়া স্বতন্ত্র জোট নামে বিএনপি নেতাদের আরেকটি জোট নির্বাচনে যাচ্ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে দলটি না ভাঙ্গলেও বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় রীতিমত অস্থিত্ব সংকটে পড়তে পারে দলটি।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।