বিশেষ প্রতিনিধি

বগুড়া বিএনপির শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। সেই বগুড়ায় মোহাম্মদ শোকরানার নাম জানেন না -এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় হচ্ছে তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ। বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক উপদেষ্টা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সেই শোকরানা-ই বিএনপিকে বাই জানিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্খী হিসেবে নির্বাচন করতে যাচ্ছেন।

শুধু শোকরানা নয়, বিএনপির ঘাঁটি বগুড়ার অন্তত আরও তিন জন নেতা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য ডা. জিয়াউল হক মোল্লা, বগুড়া সদর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সরকার বাদল এবং জেলা বিএনপির সাবেক মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বিউটি বেগম।

বিএনপির এই চার নেতা লড়বেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়ার চারটি আসন থেকে। ইতিমধ্যে জিয়াউল হক মোল্লা বগুড়া-৪, মোহাম্মদ শোকরানা বগুড়া-১, সরকার বাদল বগুড়া-৭, বিউটি বেগম বগুড়া-২ আসন থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন বলে জানিয়েছেন।

শুধু বগুড়া নয়, পুরো দেশ জুড়েই বিএনপির নেতৃত্ব দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। যার ফলে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিএনপি নেতারা হয় স্বতন্ত্র নয়তো তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, বিএনএফসহ ভিন্ন রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন।

মাঠ পর্যায়ে বিএনপি নেতাদের নির্বাচনমুখী তৎপরতায় বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি। আন্দোলন ডেকে নেতাকর্মীদের মাঠে নামাতে ব্যর্থ বিএনপি এখন দলীয় নেতাদের বহিস্কার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। যারাই নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছেন, মনোনয়নপত্র কিনছেন তাদেরকে দল থেকে বহিস্কার করা হচ্ছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দলের নেতাদের নির্বাচনে যাওয়া ঠেকাতে না পেরে বিএনপি দলীয় নেতাদের যেভাবে বহিস্কার করছে তাতে দলটির মধ্যে দেওয়ালিয়াপনা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাদের অনেকে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। এদের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে মনোনয়নপত্র কিনেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ এ কে এম একরামুজ্জামান। 

এর আগে গত ২০ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিএনপির জাতীয় কমিটির সদস্য ও ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মো. আবু জাফর যোগ দেন বিএনএম’তে। দায়িত্ব নেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের। মঙ্গলবার(২৮নভেম্বর) এই দুই নেতাকেই দল থেকে বহিস্কার করে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে বিএনপি। অথচ তারা আগেই দল ত্যাগ করে নতুন রাজনৈতিক দলে যোগদান করেছেন।

এছাড়া স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিনের নামে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে গিয়াসের পাশাপাশি তার ছেলে মুহাম্মদ কায়সারের নামেও মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ মাহমুদুল হক।

একই অবস্থা মৌলভীবাজারে। মৌলভীবাজার-১ (জুড়ী-বড়লেখা) আসনে তৃণমূল বিএনপি থেকে মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন জুড়ী উপজেলা সেচ্ছাসেবকদলের যুগ্ম আহবায়ক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।

মেহেরপুর-২ (গাংনী) আসনে তৃণমূল বিএনপি থেকে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন এলডিপি নেতা আবদুল গণি। বিএনপি ছেড়ে ২০০৭ সালে তিনি কর্নেল (অব.) অলি আহমদের এলডিপিতে যোগ দেন এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য হন। এর আগে আবদুল গণি ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে বিএনপি থেকে এ আসনে এমপি নির্বাচিত হন। আবদুল গণি ছাড়াও আরো তিন সাবেক এমপি তৃণমূল বিএনপির মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। তারা হলেন- ব্রাহ্মবাড়িয়া-১ আসনে এস এম সাফি মাহমুদ, নীলফামারী-১ আসনে অ্যাডভোকেট নুর কুতুব আলম চৌধুরী ও ঝিনাহদহ-৪ আসনে জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি নুরু উদ্দিন খান।

এর বাইরে আরও অনেক জেলায় বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য মনোনয়ন ফরম কিনেছেন বলে জানা গেছে। মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়ার শেষ দিনে জানা যাবে বিএনপি থেকে কত জন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কিংবা ভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অবশ্য শুধু যে মাঠ পর্যায়ের বিএনপি নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন, তা নয়, অনেক নেতা বিএনপি ছেড়ে যোগ দিচ্ছেন বিএনএফ, বিএনএম, তৃণমূল বিএনপিসহ বিভিন্ন সংগঠনে। সর্বশেষ মঙ্গলবার বিকালে জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী ও বিএনপির সদস্য বেবী নাজনীন যোগ দিয়েছেন বিএনএম’তে। 

বিএনপির জোট সঙ্গী বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে ইবরাহিম ঢাকার দুটি ও কক্সবাজারের একটি আসন থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এছাড়াও বিএনপির পর্যায়ের বহু স্থানীয় নেতা নির্বাচনে যেতে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করছেন। যাদের মধ্যে কয়েকজন জেলা সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকও আছেন। দল শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না গেলে তারা স্বতন্ত্র হিসেবেই নির্বাচন করবেন। দলের বহিষ্কারের বিষয়টিকে আর পাত্তা দিচ্ছেন না এই নেতারা।

তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম যে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে, এদের বেশিরভাগই এক সময়ের বিএনপির নেতা-কর্মী। তথ্যগুলো বাছাই করলে দেখা যাচ্ছে, মাঠের রাজনীতিতে সমর্থন হারাচ্ছে বিএনপি। তৃণমূলের কর্মীরা নিষ্ক্রিয় থাকছে এবং অন্য দলে যোগ দিয়ে নির্বাচনে যাওয়াতে মাঠে শক্তি হারাচ্ছে বিএনপি।  দল ছেড়ে নির্বাচনের প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে বগুড়ার চিকিৎসক জিয়াউল হক মোল্লা বলেন, “চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে এসেছিলাম। আমাকে কোনো কমিটিতে রাখা হয়নি, অপমানিত হয়েছি। চাকরিতে থাকলে এখন বড় পদে থাকতাম। সেই সুযোগও হারালাম। যেহেতু রাজনীতি করব, তাই ভোটের বিকল্প নেই।’

আর তারেক রহমানের ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ শোকরানা বলেছেন, এখন আমার বয়স ৭৪। এরপর আর ভোট করার বয়স পারমিট করবে না। এবার একটা সুযোগ এসেছে। আগামীতে আবার ভোট কবে হবে না হবে জানি না। তার ভাষায়,এমপি হলে সম্মান, প্রজন্ম এটা নিয়ে গর্ব করবে। তবে এই নির্বাচনে যাওয়া ভুল হল কি ঠিক হল তা বলবে আগামী প্রজন্ম।

এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘নির্বাচন প্রতিহত করার সিদ্ধান্তে অনড় দলীয় হাইকমান্ডকে তোয়াক্কা না করে, বিভিন্ন আসনে স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে মনোনয়ন পত্র তুলছেন বিএনপির নেতারা। আছেন কেন্দ্রীয় নেতারাও। অন্যদিকে দলছুট বহু নেতা তৃণমূল বিএনপি, বিএনএমসহ বিভিন্ন দল থেকে মনোনয়ন চেয়ে আবেদন করেছেন। তিনি বলেন, বিএনপি এসকল নেতাদের একের পর এক বহিষ্কার আদেশ দিচ্ছে। এদিকে রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী কিছুদিনে আরও বিএনপি নেতা নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিতে পারেন।