নিজস্ব প্রতিবেদক
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ের পিছনে ভূমিকা রাখবে পাঁচ ফ্যাক্টর। এরমধ্যে রয়েছে- আওয়ামী লীগের জনসম্পৃক্ততা ও জনপ্রিয়তা; বিরোধী দলের দুর্বলতা; ২৮শে অক্টোবর নতুন মোড়; দেশব্যাপী উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ ও তার রাজনৈতিক সুবিধা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিপরীতে ভারত, চীন ও রাশিয়ার সমর্থন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সব কিছু বিবেচনায় আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ে এই পাঁচ ফ্যাক্টর নিয়ামকের ভূমিকা রাখবে।
জনসম্পৃক্ততা ও জনপ্রিয়তা
বিগত ১৫ বছর ধরে টানা দেশের শাসন ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতায় থাকলে জনগণের সাথে মিশে কাজ করার যতটা সুযোগ থাকে,ক্ষমতায় না থাকলে সে সুযোগটা অনেকটাই কমে যায়। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও দলীয় নেতা কর্মীরা দীর্ঘসময় ধরেই জনগণের কাছাকাছি ছিল। বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা কর্মীদের মানুষের জন্য কাজ করার ঘটনাগুলো ছিল চোখে পড়ার মতো। যার কারণে বিগত দিনের চেয়েও বর্তমানে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা অনেক বেশি।’ এই আকাশ্চুম্বী জনপ্রিয়তাই ভোটারদের আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কায় ভোট দিতে উজ্জীবিত করবে বলে মনে করেন তিনি।
বিরোধী দলের দুর্বলতা
আওয়ামী লীগের নির্বাচনে জয়লাভের পথে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশে বিরোধী দলের রাজনৈতিক দুর্বলতা। এমনটাই মনে করেন বিশ্লেষকরা। ২০১৮ সালের নির্বাচনে হারার পরেও বিরোধী দলগুলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপর তেমন রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।বিরোধী দলগুলো নানা সময় বিভিন্ন ইস্যুতে সরব থাকলেও কোন আন্দোলনেই সাধারণ মানুষকে যুক্ত করতে পারেনি। তাদের এই দূর্বলতার কারণেই ২০১৪ ও ২০১৮ সালের তুলনায় আওয়ামী লীগ এখন অনেকটা ‘স্বস্তি-দায়ক অবস্থায়’ আছে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান বলেন, ‘বিএনপি গণতন্ত্রের কথা বলে মাঠ গরমের চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে জাতীয় নির্বাচন হয় বাংলাদেশেও ঠিক সেভাবে হবে। এর বাইরে নির্বাচন করার কোনো সুযোগ নেই। বারবার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বিএনপি নিজেদের অস্তিত্ব ধ্বংস করছে।’
২৮শে অক্টোবর নতুন মোড়
গত তিন সপ্তাহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ দ্রুত বদলেছে। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে গত ২৮শে অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশের নামে রাজনৈতিক সহিংসতা। সেদিন বিএনপি যে নাশকতা করেছে সেটি সারা পৃথিবী দেখেছে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যকে পিটিয়ে মেরেছে। প্রধান বিচারপতির বাসায় হামলা হয়েছে, হাসপাতালে হামলা হয়েছে। গণমাধ্যমের বরাতে সহিংসতার দৃশ্য দেশের মানুষ সবাই দেখছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে হরতাল অবরোধের নামে বিএনপি ও তার মিত্ররা যেভাবে সারাদেশে জ্বালাও পোড়াও করেছে তার জন্য সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সে ভূল থেকে শিক্ষা না নিয়ে ২৮ অক্টোবরের পর থেকে আবার হরতাল অবরোধের নামে জ্বালাও পোড়াওয়ের দিকে এগিয়েছে বিএনপি ও তার মিত্ররা। ফলে নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলো ভোটের হিসাবে আওয়ামী লীগ থেকে যোজন যোজন পিছিয়ে পড়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার বলেন, ‘বিএনপি সরকার পতনের স্বপ্ন যতটা দেখে, দলকে উপযুক্ত করে তোলার চেষ্টা ততটা করে না। নিজেদের ভুলত্রুটিগুলো নিয়েও বিএনপির কোনো আত্মসমালোচনা ও পর্যালোচনা নেই। রাজনীতি হলো একটি কৌশলের খেলা। এই কৌশলের খেলায় বিএনপি আওয়ামী লীগের সঙ্গে পেরে ওঠার প্রমাণ রাখতে পারেনি। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়ার সাহস থাকতে হবে বিএনপির। কিন্তু তারা যদি মনে করে তাদের কোনো ভুল নেই, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শত্রু-মিত্র তারা সঠিকভাবে নির্ধারণ করেছিল বা করেছে তাহলে তাদের আরও হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সময় বদলছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সক্ষমতা বিএনপি অর্জন করতে না পারলে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয় না।’
দেশব্যাপী উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ ও তার রাজনৈতিক সুবিধা
২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হবার পরেই দেশব্যাপী উন্নয়নের দিকে নজর দেয় আওয়ামী লীগ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগ মূহূর্তে দাঁড়িয়ে বর্তমান সরকার দেশের প্রতিটি মানুষকে কাজের মাধ্যমে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের উন্নয়নে যা করেছে তা আর কোনো সরকারই করতে পারেনি। স্বয়ং বিরোধী দলের নেতা কর্মীরাও তা স্বীকার করে। আর এই বিশাল উন্নয়নযজ্ঞের ভোটের মাঠে রাজনৈতিক সুবিধা নিবে এবার আওয়ামী লীগ। ১৪ বছরে বাংলাদেশের যোগাযোগ ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭১৮ কিলোমিটার মহাসড়ক চার বা তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করা হয়েছে। ১ লাখ ১৩ হাজার ৩০৩ মিটার সেতু নির্মাণ বা পুনঃনির্মাণ, ২১ হাজার ২৬৭ মিটার কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন সড়ক ও রেলযোগাযোগ স্থাপনের জন্য পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু, তিস্তা সেতু, পায়রা সেতু, দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতু, দ্বিতীয় মেঘনা, দ্বিতীয় গোমতী সেতুসহ শত শত সেতু, সড়ক, মহাসড়ক নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ করেছে সরকার। এছাড়া ঢাকায় মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, হানিফ ফ্লাইওভার, তেজগাঁও-মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওয়ার, কমলাপুর-শাহজাহানপুর ফ্লাইওভার, বনানী ফ্লাইওভার, টঙ্গীতে আহসানউল্লাহ মাস্টার ফ্লাইওভার, চট্টগ্রামে আক্তারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভার ও বদ্দারহাট ফ্লাইওভারসহ বহুসংখ্যক ছোট-বড় ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘বাংলাদেশকে শেখ হাসিনা ফিরিয়ে এনেছেন। সামরিক শাসক ও বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশকে প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। তিনি এখন বাংলাদেশকে সবল রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। আমি যা বর্ণনা করলাম তা হলো একটি সংক্ষিপ্তসার মাত্র। ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশের আর কোনো রাজনীতিবিদ বা সরকারপ্রধানের এত অর্জন বা সাফল্য নেই।’
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিপরীতে ভারত, চীন ও রাশিয়ার সমর্থন
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা অনেক আগে থেকেই চলমান। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে তাদের নানাবিদ পদক্ষেপের কথা সবারই জানা। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরণের পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছে পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত ভারত,চীন ও রাশিয়া। এই তিন পরাশক্তি সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের পক্ষে মতামত দিয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যতই ভিসা নিষেধাজ্ঞাসহ নিজের পছন্দমতো সরকার গঠনের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিক না কেনো,আদতে তা কার্যকর হবে বলে মনে হচ্ছেনা। যার ফলে আওয়ামী লীগের পুণরায় সরকার গঠনে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের চাপ খুব একটা বাধাগ্রস্থ করতে পারবেনা বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা।
রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.) বলেন, ‘বিশ্বের দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের ওপর। একটি উন্নয়নশীল দেশ যখন বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তখন তার অনেক ইতিবাচক দিক থাকে, তবে নেতিবাচক দিক যে থাকে না সেটিও নয়। তাই নীতিনির্ধারকদের সতর্ক ও কৌশলী হওয়া প্রয়োজন।’