উদিসা ইসলাম

মানবতা এমন কোনও বিষয় যার রূপ বদলায়। দিন গেলে যার পরিমাণ কমে আসে। কিংবা একদিকে দেখতে গিয়ে আরেকদিকে কম পড়ে গেলো কিনা। গত কয়েক বছর ধরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করার সুবাদে যতবার উখিয়া গেছি, দেখেছি ঘর ছেড়ে পালিয়ে আসা মানুষগুলো অসম্ভব প্রশান্তি নিয়ে বাস করছেন। রাজনৈতিক কোনও টেনশন সাধারণ রোহিঙ্গাদের চোখে আমি দেখি না। তারা মৃত্যু দেখে পালিয়ে এসে একটা ঘর পাবে, সেখানে নতুন করে সংসার নিয়ে বাঁচবে, তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে, এমনকি যদি অধিকার নিশ্চিত না হয় তবে সেটা তারা চেয়ে নিতে পারবে- এসব ভেবেছিল কি? মনে হয় না। শেকড় ছেড়ে আসার সময় এসব নিশ্চয়তার কথা মাথায় আসে না। বাংলাদেশ তাদের মানবতা দেখিয়েছিল ষোলোআনা।

এরপর তাদের ফিরিয়ে দেওয়া, মিয়ানমারের পরিস্থিতি দেখে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়গুলো যখন এলো, তখনও সতর্ক আছে বাংলাদেশ। যদিও বাস্তবতা হলো রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতেই হবে। একটা দেশ তার মানবতার খাতিরে সীমান্ত খুলে দিয়ে ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে জায়গা দিয়েছে। তাদের যাপিত জীবনের সব নিশ্চয়তা দিতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু এটি তো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হতে পারে না। সেই মানবতা যখন বাংলাদেশ দেখিয়েছে, বাংলাদেশের প্রতিও বিশ্বকে সেই প্রশংসার চোখ দিয়ে দেখে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করতে হবে বৈকি।

রোজ সকালে যখন পত্রিকার পাতায় গাজায় ইসরায়েলি হামলার সবচেয়ে কাতর হয়ে যাওয়ার মতো ছবি প্রকাশিত হতে দেখি, তখন সেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কথা মনে পড়ে। সেখানে নিশ্চয়তা অথচ গাজায় কী অনিশ্চয়তা নিয়ে কোনোমতে টিকে আছে নারী-শিশুরা। ২১ নভেম্বর অবরুদ্ধ গাজার নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলায় নারী ও শিশুসহ ১৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ওয়াফার বরাত দিয়ে এ খবর জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।

এরইমধ্যে প্রথমবারের মতো হামাসের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে রাজি হচ্ছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের সঙ্গে হামাসের যুদ্ধবিরতি প্রসঙ্গে টেলিগ্রামে পোস্ট করা একটি বার্তায় হামাস প্রধান ইসমায়েল হানিয়াহ বলেছেন, আমরা একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছানোর কাছাকাছি রয়েছি। এনডিটিভির তথ্য অনুসারে, ২১ নভেম্বর মঙ্গলবার নিজের টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা একটি বার্তায় এ কথা জানিয়েছেন হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়াহ। এর আগে গাজার মধ্যাঞ্চলে নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরটি বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করে। গত মাসে ইসরায়েল নুসেরাইত শরণার্থী শিবির ও গাজার একটি গির্জাকে লক্ষ্য করে হামলা চালালে ৪৬ জন নিহত হয়। এদিকে জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের একটি আবাসিক ভবনে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার পর ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে তিনটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও কয়েকজন আটকা পড়ে থাকতে পারেন বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে গাজার জেনিনের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত আরাবা শহরে অভিযান চালিয়েছে ইসরায়েলি সেনারা। যেখানে এক যুবকদের সঙ্গে ইসরায়েলি সেনাদের সংঘর্ষের একপর্যায়ে ওই যুবককে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে ইসরায়েলি সেনারা। এ ঘটনায় আহত হয় ওই যুবক। জেনিনের পাশে গাজার কাবাতিয়া নামক একটি অঞ্চলে আরেকটি ইসরায়েলি অভিযানের খবর পাওয়া গেছে।

গাজা-ইসরায়েল সংঘাত শুরুর থেকে প্রতিদিনই চলছে মৃত্যুর মিছিল। এরই মধ্যে ৪৫ দিনে গড়িয়েছে চলমান সংঘাত। ইসরায়েলি আগ্রাসনে ফিলিস্তিনি নিহতের সংখ্যা ১৩ হাজার ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আর এ খবর নিশ্চিত করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ফিলিস্তিনে নিহতের সংখ্যা ১৩ হাজার। এর মধ্যে ৫ হাজার ৫০০ শিশু ও ৩ হাজার ৫০০ নারী। আহতের সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে। এছাড়া নিখোঁজের সংখ্যা ছয় হাজার, যাদের বেশিরভাগই ধসে যাওয়া ভবনের নিচে চাপা পড়েছেন।

এই ভয়াবহ সহিংসতা সরাসরি মার্কিন মদতে হয়ে থাকে বলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা দাবি করেন। অথচ পরিস্থিতি যখন ভয়াবহ তখন তারা লোক দেখানো নানা বিবৃতি দিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একদিকে বলেন, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘাত দূর করার একমাত্র উপায় হলো দ্বিরাষ্ট্র সমাধান, আরেকদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও কাজ করে। পশ্চিম তীরে যে সহিংসতা চলছে তা যদি বন্ধ না হয় তবে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তাহলে প্রশ্ন হলো, প্রতি বছর ইসরায়েল সফরে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যরা কেন যান? এসব সফরে কেন খরচ করা হয় লাখ লাখ ডলার। এ আয়োজনের মাধ্যমে মার্কিন কংগ্রেসে ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন জোগাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ওয়াশিংটনের অন্যতম প্রভাবশালী লবিং গ্রুপ আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (এআইপিএসি)। কংগ্রেস সদস্যদের এসব সফরে কারা অর্থায়ন করে থাকে এ বিষয়ে সম্প্রতি তথ্য প্রকাশ করেছে মার্কিন অলাভজনক সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ইন্টারসেপ্ট’। প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক দাতাদের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ বা পারিবারিক দাতাদের নামও রয়েছে। তবে কংগ্রেস সদস্যদের (প্রতিনিধি ও সিনেটর) ইসরায়েল সফরে ঠিক কে বা কারা অর্থায়ন করে তা এক রহস্যই রয়ে গেছে। এ রহস্যের বেড়াজাল ভেদ করে সেসব ‘গোপন’ দাতাদের নাম উন্মোচন করা এখনও পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। তবে ২০১৯ ট্যাক্স ফাইলিংয়ের একটি অসংশোধিত কপি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এআইপিএসি-কে কারা তহবিল দেয় তাদের কয়েকজনের নামের একটি তালিকা পেয়েছে ইন্টারসেপ্ট।

যেখানে রোজ যে শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে, হাসপাতালে হামলা করতেও পিছপা হচ্ছে না, সেখানে মানবতার কথা কেন বলেন না তারা। মোড়লদের কোনও না কোনও স্বার্থ সম্পৃক্ত না থাকলে মানবতা কেন, কোনও বিষয়েই তারা মাথা ঘামান না। মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিকে কেন্দ্র করে গাজা সংকটে বিশ্বনেতাদের এই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে বের হয়ে এসে আরেকটু মানবিক হতে আহ্বান জানান ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ’র প্রধান ফিলিপ্পে লাজারিনি। তার মতে, বিশ্ব এখন মানবতা হারাচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্বমোড়লদের অবস্থান বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি না যে এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও শান্তির স্বার্থে এত মানুষ হত্যা। আমরা এখন এমন একটি পরিস্থিতিতে আছি, যেখানে গাজা ভূখণ্ডে সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ করা হচ্ছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে আছি, যেখানে ১০ লাখেরও বেশি মানুষকে বাস্তুচ্যুত বা ঘরবাড়ি ছাড়তে বলা হয়েছে। ফলে এটি হলো সম্মিলিত শাস্তি, যেটি আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের লঙ্ঘন।

এত বড় মানবিক লঙ্ঘনে কোনও আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার পাবে না গাজার মানুষ? ইসরায়েল ও এই সংঘাতের সঙ্গে জড়িতরা কি আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের ঊর্ধ্বে? যাদের চোখে বাংলাদেশসহ বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশে ‘মানবাধিকার’ খুঁজে ফেরে তারা কেন এই কান্না শুনতে পান না। সেখানে কেন মানবাধিকারের কথা বাতাসে ভাসে না? স্বার্থের কাছে হেরে গিয়ে কোথাও কোথাও মানবতা মরে যায়?

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, বাংলা ট্রিবিউন।