প্রফেসর ড. এম. এম. মাহবুব আলম

ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণে নিষ্পেষিত পূর্ব বাংলা, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হয়ে স্বাধীনতা লাভ করলেও পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের নিষ্পেষণে জর্জরিত হতে থাকে এই অঞ্চলের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সামাজিক বিকাশ।

পাকিস্তানি শাসকদের সব বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র—‘বাংলাদেশ’-এর অভ্যুদয় ঘটে।

সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু জাতির পিতা সময়োপযোগী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের উর্বর জমি, কৃষিজ সম্পদ ও কর্মক্ষম বিশাল জনগোষ্ঠী কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে গড়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।

স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিদের সহযোগিতায় কিছু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে তার ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্নকে ভূলুণ্ঠিত করে এবং দেশ চলে যায় সামরিক শাসকদের নিয়ন্ত্রণে।

ঘাতকের বুলেটের আঘাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত শেখ ফজিলাতুননেসা মুজিব তার স্বামী-বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে, জেলে বন্দি থাকার সময় ও স্বাধীনতা পরবর্তীতে রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রেরণা, সাহস ও শক্তি জুগিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে যখন চরম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বিরাজ করছিল। ঠিক তখনই জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ কন্যা-শেখ হাসিনা সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে প্রিয় স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তারপর থেকে স্বৈরাচার বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন।

১৯৯৬ সালের ২৩ জুন তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হন এবং বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করে এদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ থেকে অদ্যাবধি দীর্ঘ ২০ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ও ‘রূপকল্প-২০২১ (উন্নয়নশীল দেশ)’ বাস্তবায়ন করেন।

বর্তমানে ‘রূপকল্প-২০৪১ (স্মার্ট বাংলাদেশ)’ ও ‘ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ বাস্তবায়নেও তিনি নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের ফলে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ এখন পৃথিবী অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি তথা খাদ্যশস্য উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হয়েছে।

তাই তো, পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়ক, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংস্থার প্রধানরা বাংলাদেশকে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সূচকে পিছিয়ে থাকা অন্যান্য রাষ্ট্রকে বাংলাদেশের উন্নয়ন মডেলকে অনুসরণ করতে পরামর্শ দিচ্ছেন।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ ইতিমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণের সব সূচক অতিক্রম করেছে। মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা তথা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে শেখ হাসিনার দৃঢ়তা, দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য ‘টাইমস ম্যাগাজিন’ বিস্ময়কর রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

একজন নারী হয়েও বাংলাদেশের উত্তর উত্তর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে তিনি যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে চলেছেন।

শেখ হাসিনার গৃহীত বিভিন্ন নারীবান্ধব কর্মসূচির সুবাদে এই দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী-নারীরাও দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন। তাই, প্রসঙ্গত মনে পড়ছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর সেই বিখ্যাত উক্তি—‘ বিশ্বে যা-কিছু মহান্‌সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’।

বর্তমান সরকার গৃহীত যেসব কর্মসূচি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে নারীদের ভূমিকা রাখতে সহায়তা করছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—

(ক) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০২০ অনুমোদন এবং এই আইনের ধারাসমূহের যথাযথ প্রয়োগের ফলে বাংলাদেশের নারী ও শিশুরা নিরাপদে শিক্ষা গ্রহণ ও নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে নির্ভয়ে ও সফলতার সাথে কাজ করতে পারছে;

(খ) প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদানের ফলে শিক্ষার্থীদের ভর্তির হার বৃদ্ধি, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ, বাল্যবিবাহ রোধ, চাকরির সুযোগ ও উপার্জন ক্ষমতা বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন ও জেন্ডার সমতা অর্জন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করে পরিকল্পিত পরিবার গঠন করতে সক্ষম হচ্ছে;

(গ) বর্তমান সরকার জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন যাতে করে দেশের সব অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায় ফলে উচ্চ শিক্ষা বিশেষ করে মেডিক্যাল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও কৃষি বিষয়ক শিক্ষায় নারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে;

(ঘ) কর্মক্ষেত্রে নারীরা এখন বিনা বাধায় পুরুষদের পাশাপাশি কাজ করছে এবং সমানভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে। পোশাক শিল্প বাংলাদেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। এই শিল্পের সিংহভাগ কর্মীই নারী যারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র ও অসচ্ছল পরিবার থেকে আসে। ফলে গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এইসব নারীরা ব্যাপক ভূমিকা রাখছে;

(ঙ) ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ফলে অনেক নারীরা নিজ বাসস্থানে অবস্থান করেও অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনা এবং অনলাইন শপিং করতে পারছে;

(চ) সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ প্রদান করার ফলে অনেক নারী উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে;

(ছ) বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হওয়ায় অনেক নারীরা নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশে কাজ করার ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ পাচ্ছে।

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, ‘তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো’। আর এই কাজটিই যেন করে চলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১১ এপ্রিল ২০২৩, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা প্রদান করেন যে, ‘অর্থনীতিতে ঘরের কাজ বা গৃহস্থালি কাজের অবদান স্বীকার করতে হবে।’

এটা করা গেলে আমাদের জিডিপি আরও বাড়বে। ঘরের কাজের আর্থিক মূল্যায়ন আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে জিডিপিতে কীভাবে যুক্ত করা যায়, তার উপায় খুঁজে বের করতে বিআইডিএসকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

পরিশেষে বলতে চাই, যতদিন শেখ হাসিনার হাতে দেশ, পথ হারবে না বাংলাদেশ। অর্থাৎ, নারীর হাতে সমৃদ্ধ অর্থনীতি তথা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

প্রফেসর ড. এম. এম. মাহবুব আলম, মৎস্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট