অস্ট্রেলিয়ার দাপটে ভারতের ১৪০ কোটি মানুষের স্বপ্নভঙ্গ। ওয়ানডে বিশ্বকাপে টানা ১০ ম্যাচ জিতে উড়ছিল স্বাগতিক ভারত। তাতে এক যুগ পর শিরোপা জেতার হাতছানি ছিল ভারতের। টুর্নামেন্টজুড়ে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা রোহিত শর্মাদের নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন অনেকেই। ফাইনালে এসেই হোঁচট খেল ভারত। ব্যাটিং ব্যর্থতার পর বোলিংয়েও তেমন ছাপ রাখতে পারলেন না বোলাররা। ভারতকে ৬ উইকেটে হারিয়ে অস্ট্রেলিয়ার রেকর্ড ষষ্ঠ শিরোপা জিতে নিল। ফাইনালে ম্যাচ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ট্রাভিস হেড। ১৩৭ রানের ইনিংস খেলে অস্ট্রেলিয়াকে জয়ের শেষ প্রান্তে নিয়ে যান। আর এই কৃতিত্বের জন্য ম্যাচসেরা নির্বাচিত হন তিনি।

আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে গতকাল ভারতের ট্রফি জয়ের আনন্দ উপভোগ করতে হাজির হয়েছিলেন এক লাখ ৩০ হাজার দর্শক। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এই ভেন্যুর ধারণক্ষমতার হিসাবে দেখা হলে বাস্তবে নিশ্চিতভাবেই সংখ্যাটা আরও বেশি হবে। নীল সমুদ্রে যেন ভাসছিল আহমেদাবাদ। তবে এই সমুদ্রসম দর্শকদের নিস্তব্ধ করার কথা আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক প্যাট কামিন্স। দারুণ পারফরম্যান্সে মাঠে গতকাল ঠিকই দর্শকদের ‘চুপ’ করিয়ে দিলেন। ঘরের মাঠে পুরো বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে দারুণ ফর্মে ছিলেন ভারতের ব্যাটাররা। কিন্তু ফাইনালে এসেই যেন হোঁচট খেতে হলো টিম ইন্ডিয়াকে। প্রায় দেড় লাখ দর্শকের সামনে পাহাড়সম চাপ সামলে উঠতে পারেনি তারা। যার ফলে ইনিংসে শেষ বলে মাত্র ২৪০ রানেই অলআউট হয়ে যায় রোহিত শর্মার দল। ব্যাট হাতে লোকেশ রাহুল ৬৬, বিরাট কোহলি ৫৪ ও অধিনায়ক রোহিত শর্মা ৪৭ রানের ইনিংস খেলেন। জবাবে ৪২ বল বাকি থাকতেই ৪ উইকেট হারিয়ে জয় তুলে নেয়।

ফাইনালের আগে টুর্নামেন্টজুড়েই আধিপত্য দেখিয়েছে স্বাগতিক ভারত। ব্যাটিং কিংবা বোলিং- সবক্ষেত্রেই পারফরম্যান্স দেখিয়েছে সমানতালে। কিন্তু সেই তাদেরই ফাইনাল শেষে মাঠ ছাড়তে হলো মাথা নিচু করে। বিরাট কোহলি ও মোহাম্মদ সামি অবশ্য এই ভেবে সান্ত্বনা পেতে পারেন যে, টুর্নামেন্ট শেষে তাদের কপালে জুটেছে সেরা ব্যাটার ও সেরা বোলারের তকমা।

১১ ম্যাচে ৩ সেঞ্চুরি ও ৬ ফিফটিসহ ৯৫.৬২ গড়ে ৭৬৫ রান করেছেন কোহলি। ভেঙেছেন বিশ্বকাপের এক আসরে কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকারের করা ৬৭৩ রানের রেকর্ড। ৫৯৭ রান নিয়ে দুইয়ে আছেন কোহলিরই সতীর্থ রোহিত শর্মা। ভারতীয় অধিনায়ক ৫৪.২৭ গড়ে ব্যাট করে এবারের আসরে এক সেঞ্চুরি ও তিনটি ফিফটি হাঁকিয়েছেন। ১০ ম্যাচে ৫৯৪ রান নিয়ে তিনে আছেন দক্ষিণ আফ্রিকার কুইন্টন ডি কক। ৫৭৮ ও ৫৫২ রান নিয়ে যথাক্রমে চার ও পাঁচে নিউজিল্যান্ডের রাচিন রবীন্দ্র ও ড্যারিল মিচেল। বোলারদের মধ্যে ২৪ উইকেট নিয়ে শীর্ষে সামি। অথচ ভারতের হয়ে প্রথম চার ম্যাচে খেলারই সুযোগ পাননি ডানহাতি এই পেসার। তবে সুযোগ পাওয়ার সঙ্গে জায়গাটা পাকা করে নেন। ২৩ উইকেট নিয়ে দুইয়ে অজি লেগ স্পিনার অ্যাডাম জাম্পা। বিশ্বকাপ ইতিহাসে স্পিনার হিসেবে এক আসরে সর্বোচ্চ উইকেট পাওয়ার রেকর্ডে মুত্তিয়া মুরালিধরনকে ছুঁয়েছেন তিনি।

লংকানদের জন্য বিশ্বকাপটা দুঃস্বপ্নের হলেও বল হাতে দারুণ ছাপ রেখেছেন দিলশান মাদুশঙ্কা। ৯ ম্যাচে ২১ উইকেট নিয়ে তিনে আছেন বাঁহাতি এই পেসার। এছাড়া ২০ উইকেট শিকার করেছেন জসপ্রিত বুমরাহ ও জেরাল্ড কোজি।

চলতি বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে দারুণ এক প্রতিশোধ নিল অস্ট্রেলিয়া। গত ৮ অক্টোবর চেন্নাইয়ে ৬ উইকেটে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল। সেই অস্ট্রেলিয়ার কাছে ফাইনালে একই ব্যবধানে হারল ভারত।

জয়ের জন্য ২৪১ রানের লক্ষ্য নিয়ে ব্যাট করতে নেমে ৪৭ রানের মধ্যে তিন উইকেট হারিয়ে শুরুতে চাপে পড়ে অস্ট্রেলিয়া। এরপর ট্রাভিস হেড ও লাবুশেনের জুটিতে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় প্যাট কামিন্সের দল। চলতি বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি করেন ট্রাভিস হেড। ৯৫ বলে ১৪ চার ও ১ ছয়ে তিন অঙ্কের ঘরে পৌঁছান তিনি। ধর্মশালায় নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১০৯ রান করেন তিনি। সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তিনি খেলেন ৬২ রানের ইনিংস। চতুর্থ উইকেটে ২৩৯ রানের মাথায় পরাস্ত হন ট্রাভিস হেড। ১২০ বল খেলে ১৫টি চার ও ৪টি ছক্কা হাঁকিয়ে ১৩৭ রান করেন ট্রাভিস।

লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ৪৭ রানের মধ্যেই ৩ উইকেট হারিয়ে বিপর্যয়ে পড়েছিল অস্ট্রেলিয়া। এরপর ১৯২ রানের অতিমানবীয় জুটি গড়েন ট্রাভিস হেড ও মার্নাস লাবুশেন। হেড ১৩৭ রান করে ফিরলেও লাবুশেন ৫৮ রানে অপরাজিত থেকে ৪২ বল হাতে রেখে জয় তুলে নেয় অজিরা। এতে রেকর্ড ষষ্ঠবারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব পেল প্যাট কামিন্সের দল। জসপ্রিত বুমরাহ ২টি এবং মোহাম্মদ সামি ও সিরাজ ১টি করে উইকেট দখল করেন।

আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া টস জিতে ব্যাটিংয়ে পাঠায় দুইবারের শিরোপাধারী ভারতকে। দীর্ঘ দেড় মাসের মহাযজ্ঞ শেষে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক প্যাট কামিন্স। দুই দলই অপরিবর্তিত একাদশ নিয়ে নামে।

পঞ্চম ওভারেই অস্ট্রেলিয়াকে উইকেট এনে দেন মিচেল স্টার্ক। শুবমান গিলের বিদায়ে ভাঙল ভারতের ৩০ রানের উদ্বোধনী জুটি। ৭ বলে ৪ রান করে আউট হন তিনি। কিছুটা শর্ট লেংথের ডেলিভারি ঠিকমতো পুল করতে পারেননি গিল। বল চলে যায় সোজা মিডঅনে। অনায়াসে ক্যাচ লুফে নেন অ্যাডাম জ্যাম্পা। ১ উইকেটে ৩০। রোহিত শর্মার সঙ্গী হন বিরাট কোহলি।

প্রথম পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে গুরুত্বপূর্ণ উইকেট তুলে নেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মাকে বিদায় করে অস্ট্রেলিয়াকে উল্লাসে মাতান তিনি। কভার থেকে পেছনের দিকে দৌড়ে ডাইভ দিয়ে অসাধারণ ক্যাচ নিলেন ট্রাভিস হেড। দুই পেসার মিচেল স্টার্ক ও জশ হ্যাজেলউড সুবিধা করতে পারছেন না দেখে অষ্টম ওভারেই বোলিংয়ে পরিবর্তন আনেন অজি দলনেতা প্যাট কামিন্স। আক্রমণে নিয়ে এলেন স্পিন অলরাউন্ডার গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে। তিনি নিজের দ্বিতীয় ওভারেই আউট করলেন বিপজ্জনক রোহিতকে। ৩১ বলে ৪ চার ও ৩ ছক্কায় রোহিতের রান ৪৭। ৭৬ রানে দ্বিতীয় উইকেটের পতন। রোহিতের পর বিদায় নেন শ্রেয়াস। শ্রেয়াস আইয়ার ক্রিজে এসে প্রথম বলেই চার মেরেছিলেন। তৃতীয় বলেই জস ইংলিসের কাছে ক্যাচ দেন তিনি। ৩ বলে মাত্র ৪ রান করেন এ ব্যাটার। ৮১ রানে তৃতীয় উইকেটের পতন। বিরাট কোহলির সঙ্গে ব্যাট হাতে ক্রিজে নামেন লোকেশ রাহুল।

৩ উইকেট হারিয়ে সতর্ক ভারতীয় ব্যাটাররা। সাবধানী ব্যাটিং করছেন বিরাট কোহলি ও লোকেশ রাহুল। পাওয়ার প্লের পর আর কোনো বাউন্ডারিই মারেননি তারা। ধীরগতিতে ব্যাটিং করে অবশ্য এর মধ্যে জুটির ফিফটি তুলে নেন এই ব্যাটার।

১৬.১ ওভার কোনো বাউন্ডারি দেখা যায়নি কোহলি-রাহুলের ব্যাটে। জুটির ফিফটির পর কোহলিও দেখা পান ফিফটির। আসে বাউন্ডারিও। জাম্পাকে প্যাডেল সুইপ করে বাউন্ডারির বাইরে পাঠান রাহুল। আহমেদাবাদের প্রায় ১ লাখ ৩২ হাজার দর্শককে স্তব্ধ করে দিয়ে বিরাট কোহলি বোল্ড! গ্যালারিতে স্ত্রী আনুশকা শর্মার চোখেমুখে স্পষ্ট বিষাদের ছাপ। ডাগআউটে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের মাথায় হাত। কামিন্সের শর্ট লেংথের বল আলতো করে খেলতে চেয়েছিলেন কোহলি। তবে বল এতটা উঠবে, ভাবতে পারেননি। ব্যাটের কানায় লেগে বল গিয়ে ভেঙেছে স্টাম্প। ফাইনালের মহাগুরুত্বপূর্ণ উইকেট নিলেন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক কামিন্স। কোহলি থেমেছেন ৬৩ বলে ৫৪ রান করে। ১৪৮ রানে চতুর্থ উইকেট হারানোর পর ব্যাট হাতে নামেন রবীন্দ্র জাদেজা।

প্যাট কামিন্সের পর আক্রমণে ফিরেই উইকেট শিকারে যোগ দেন অজি পেসার জশ হ্যাজেলউড। ভারত হারায় পঞ্চম উইকেট। রবীন্দ্র জাদেজা আউট হন ২২ বলে ৯ রানে। থামে ৪৪ বলে ৩০ রানের সম্ভাবনাময় জুটি। আগের বলেই রিভিউ নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু রিপ্লেতে দেখা যায়, বল উইকেটরক্ষক জশ ইংলিসের গ্লাভসে জমা পড়ার আগে জাদেজার ব্যাট ছুঁয়ে যায়নি। তবে পরেরবার আর বাঁচলেন না এই বাঁহাতি ব্যাটার। রাউন্ড দ্য উইকেটে করা হ্যাজেলউডের ফুল লেংথ ডেলিভারি তার ব্যাটের কানায় লেগে যায় ইংলিসের কাছে। ৩৬ ওভার শেষে ভারতের সংগ্রহ ৫ উইকেটে ১৭৮ রান। সাত নম্বরে ব্যাট হাতে নামেন সুর্যকুমার।

ভারতের শেষ ভরসার জুটি রাহুল-সুর্যকুমার। কিন্তু রাহুলের ফিরে যাওয়ায় বিপদে পড়ে ভারত। ৬ষ্ঠ উইকেটে দলীয় ২০৩ রানের মাথায় আউট হন লোকেশ রাহুল। রাউন্ড দ্য উইকেটে এসে ব্যাক অব লেন্থে অফে বল ছুড়েন স্টার্ক। তাতেই পরাস্ত ভারতকে ভরসা দেখানো রাহুল। খোঁচা দিয়ে বসেন রাহুল, বল চলে যায় ইংলিসের গ্লাভসে। ১০৭ বলে মাত্র ১টি চারে ৬৬ রান করেছিলেন রাহুল। এক প্রান্তে টিকে থেকে দলের সংগ্রহ দুইশ’ পার করেন এই উইকেটরক্ষক ব্যাটার। প্রয়োজন ছিল শেষ পর্যন্ত থেকে চ্যালেঞ্জিং স্কোর এনে দেওয়া। কিন্তু পারলেন না। ক্রিজে সুর্যকুমারে সঙ্গী হন সামি। মোহাম্মদ সামি ও সুর্যকুমারের জুটিতেও ভারত এগোতে পারেনি। ৭ম উইকেটে সামি মাত্র ৬ রান করে সাজঘরের পথ ধরেন।

ইনিংসের শেষ বলে অলআউট হলো ভারত। ডাবল নেওয়ার চেষ্টায় রানআউট হয়ে যান কুলদীপ যাদব। ১৮ বলে তার সংগ্রহ ১০ রান। মোহাম্মদ সিরাজ অপরাজিত থাকলেন ৮ বলে ৯ রানে।

অজিদের হয়ে ৫৫ রানে সর্বোচ্চ ৩ উইকেট নেন বাঁহাতি পেসার স্টার্ক। দুই ডানহাতি পেসার কামিন্স ও হ্যাজেলউড দুটি করে উইকেট পান যথাক্রমে ৩৪ ও ৬০ রান খরচায়। তিন ফাস্ট বোলারই পূরণ করেন নিজেদের ১০ ওভারের কোটা।

সংক্ষিপ্ত স্কোর

ভারত: ৫০ ওভারে ২৪০ (শুবমান ৪, রোহিত শর্মা ৪৭, শ্রেয়াস ৪, কোহলি ৫৪, জাদেজা ৯, লোকেশ রাহুল ৬৬, সুর্যকুমার ১৮, সামি ৬, বুমরাহ ১, কুলদ্বীপ ১০, সিরাজ ৯*; মিচেল স্টার্ক ৩/৫৫, হ্যাজেলউড ২/৬০, ম্যাক্সওয়েল ১/৩৫, প্যাট কামিন্স ২/৩৪, জাম্পা ১/৪৪)।

অস্ট্রেলিয়া: ৪৩ ওভারে ২৪১/৪ (ওয়ার্নার ৭, ট্রাভিস হেড ১৩৭, মার্শ ১৫, স্মিথ ৪, লাবুশেন ৫৮*, ম্যাক্সওয়েল ২*; বুমরাহ ২/৪৩, ১/৪৭, মোহাম্মদ সামি ১/৪৫, জাদেজা ০/৪৩, ০/৫৬)।

ফল: অস্ট্রেলিয়া ৬ উইকেটে জয়ী।