প্রফেসর ড. মো. সেকেন্দার আলী

বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২৪ সালের ২৯শে জানুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষে অধিকাংশ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে উক্ত ৯০ দিনের মধ্যে একটি তারিখ নির্ধারণ করে ও নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয়ারলী যুক্ত করে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হয়। এহেন প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন গত ১৫ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। নির্বাচন সংক্রান্ত আইন এবং নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের মাধ্যমে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা নিশ্চিত করা আছে। এ অনুচ্ছেদ মতে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় অভিযোগ করে যে নির্বাচন কমিশন সরকারের ‘আজ্ঞাবহ’ থাকে, আর ক্ষমতাসীন সরকার সবসময় নির্বাচন কমিশন স্বাধীন বলে দাবি করে।

তফসিল ঘোষণার পর আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন চাইলে প্রশাসনের মধ্যে রদবদল করতে পারে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বলা হয়েছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে বিভাগীয় কমিশনার, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং তাদের অধস্তন কর্মকর্তাদের নির্বাচন কমিশনের সাথে আলোচনা ছাড়া বদলি করা যাবে না।

অন্যদিকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে বদলি করার প্রয়োজন হলে নির্বাচন কমিশন লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাবে। এরপর যত দ্রুত সম্ভব সে বদলি কার্যকর করতে হবে। যদি কোন প্রার্থী নির্বাচনী আইন ও আচরণ বিধির গুরুতর লঙ্ঘন করেন, সেক্ষেত্রে প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে নির্বাচন কমিশন। এ বিষয়টিতে নির্বাচন কমিশনের পুরোপরি এখতিয়ার আছে। বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকগণ রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে উল্লেখ করা আছে, একজন রিটার্নিং অফিসারকে নির্বাচন কমিশন যেভাবে দায়িত্ব দেবে, তিনি সে দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য থাকবেন। একজন রিটার্নিং অফিসার একটি এলাকায় ‘অল ইন অল’ বা সর্বেসর্বা। তার তত্ত্বাবধানের নির্বাচন পরিচালিত হয়। রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ ও বাতিল করা নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার। নির্বাচনী কার্যক্রম ও ভোট চলাকালে নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা কমিশনের হাতে আছে। তবে নির্বাচনের ফলাফল গেজেট বা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হবার পরে পুরো নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করা যাবে না। ভোট চলাকালীন নির্বাচন কমিশনের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা আছে।

কমিশন আবশ্যিক মনে করলে ফলাফল গেজেট প্রকাশ করা স্থগিত রাখতে পারবে। নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ তদন্ত করতে পারবে। তদন্তের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে সংগত মনে করলে যেসব কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে সেসব কেন্দ্রের ফলাফল বাতিল করতে পারে।

উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে গাইবান্ধায় একটি আসনে উপ-নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দিন অনিয়মের অভিযোগে সেদিনই ভোটগ্রহণ বাতিল করে নির্বাচন কমিশন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার তফসিল ঘোষণার সাথে সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার জন্য দায়িত্ব পালন করার বিষয়টিও উল্লেখ করেন। নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার যেকোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে কার্যকরভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়, নির্বাচন অধিক পরিশুদ্ধ ও অর্থবহ হয়।”

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ ১৭টি রাজনৈতিক দল স্বাগত জানিয়েছে। অন্য দিকে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপি সহ কয়েকটি দল তফসলকে প্রত্যাখান করে নির্বাচন না করার ঘোষনা দিয়েছে। 

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার দৈনন্দিন রুটিন কাজ ছাড়া কোন উন্নয়নমূখী প্রকল্প নতুন করে অনুমোদন দিচ্ছে না। ফলে সংবিধান মোতাবক তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনে কোন বাধা নেই।   আওয়ামীলীগসহ নির্বাচনমূখী দলসমূহ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।

এহেন পরিস্থিতিতে বিএনপি কী করবে জানতে চাইলে রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, “আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করবো। সরকার আগের মতো নির্বাচন করতে পারবে না এবং সেটিই আমরা নিশ্চিত করবো।” কিন্তু কীভাবে সেটি হতে পারে তার কোন সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দলটির নেতাদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। বিএনপি তাকিয়ে আছে পশ্চিমাদের দিকে। কিন্তু পশ্চিমারা সবকিছু নিজের মতো করে করাতে পারবে তার তো নিশ্চয়তা নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হিসেবে ভারতের ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্র্ণ।

ভারত সম্প্রতি দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক বৈঠকে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গ তুলে এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে।

বিএনপির সামনে এখন দুটো পথ খোলা আছে, যথা ১) যে কোনভাবে হোক নির্বাচন ঠেকানো, এবং ২) তফসিল অনুযায়ী দ্রুত নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া। নির্বাচন ঠেকাতে হলে হরতাল-অবরোধসহ সহিংসতা করতে হবে। এর বিরুদ্ধে আবার যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির হুমকি আছে।

আবার শুধু হরতাল অবরোধ দিয়ে এমন কোন পরিস্থিতি বিএনপি তৈরি করতে পারেনি যাতে সরকার দাবি মানতে বাধ্য হয়। বিএনপি চাইছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করুক। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে নির্বাচন সংবিধানে থাকা নিয়ম অনুযায়ী সম্পন্ন হবে। এক্ষেত্রে কোনও চাপ তারা গ্রহণ করতে রাজি নয়।

এমতাবস্থায় তফসিল অনুযায়ী দ্রুত নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়াই বিএনপির জন্য মঙ্গলজনক। বিএনপির যদি নির্বাচনের ব্যাপক প্রস্তুতি না থাকে, তবে নির্বাচনের তারিখ কিছুটা পরিবর্তনের আবেদন করতে পারে।

নির্বাচন কমিশন চাইলে চলমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের তারিখ বদলাতে পারে। যদি সেটি দরকার হয় তাহলে নির্বাচন কমিশনের সে এখতিয়ার রয়েছে। সেক্ষেত্রে তফসিল সংশোধন করে দেয়া যায়। এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য তারিখগুলো পরিবর্তন করে দিতে পারে কমিশন। যেমন ২০০৮ সালে ড. এ টি এম শামসুল হুদার নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ নির্বাচনের তারিখ দিয়েছিলো। কিন্তু বিএনপি তখন নির্বাচনে আসবে কিনা সেনিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছিল। এরপর বিএনপির দাবির ভিত্তিতে তাদের সাথে আলোচনার পর নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে ২৯ ডিসেম্বর করা হয়েছিলো।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিএনপি এরূপ সুযোগ নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তা  বিএনপির জন্য মঙ্গলজনক হবে এবং নির্বাচনটিও অধিক প্রতিযোগিতাপূর্ণ হবে। অন্যথায় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলের সমন্বয়ে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ গঠিত হবে – এটি সন্দেহাতিতভাবেই বলা যায়।

লেখক: সাবেক প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।