অধ্যাপক ড. বিপ্লব মল্লিক

শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। উপযুক্ত শিক্ষা মানুষের মেধা বিকশিত করার মাধ্যমে তাকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। তাই দেশে দেশে শিক্ষা সচেতন মানুষ শিক্ষার অধিকার আদায়ে সক্রিয়। এই সত্যটি উপলব্ধি করেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ সৃষ্টির পূর্ব থেকেই শিক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনে তিনি কার্যকরী সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় শিক্ষায় পুঁজি বিনিয়োগ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করা, দারিদ্র্যের কারণে মেধাবী শিক্ষর্থীরা যেন উচ্চশিক্ষা বিমুখ না হয় এরকম সুস্পষ্ট কিছু প্রস্তাব রেখেছিলেন।

পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর পরই শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও পাকিস্তানি ধারা পরিত্যাগ করে বাঙালি জাতির বিকাশের উপযোগী একটি সুস্থ ধারার শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া একটি দেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন। এজন্য শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়ন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং যুগোপযোগী কৌশল ও পরিকল্পনা গ্রহণ করার লক্ষ্যে প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই শিক্ষা কমিশন গঠন এবং এর মাধ্যমে একটি প্রগতিশীল শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন।

বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেন, মাদ্রাসা এডুকেশন অর্ডিন্যান্স ১৯৭২ এবং প্রাইমারি এডুকেশন অ্যাক্ট ১৯৭৪ নামে দুটি আইন প্রণয়ন করেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা, কারিগরি সব ক্ষেত্রেই আধুনিক ও মানসম্পন্ন শিক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

১৯৭৩ সালে উচ্চশিক্ষা প্রসারে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীন পেশা ও বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশের চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সরকারই প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে শিক্ষা খাতে ৭% বরাদ্দ বেশি রেখেছিলেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষা দিয়েই দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করে জাতিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।

বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালে ২য় বারের মতো ক্ষমতায় এসে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর নিমিত্তে আধুনিক সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের শিক্ষা কমিশনের আলোকে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন, সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতকরণে অভিন্ন পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, শিশুদের মধ্যে গণতন্ত্র ও নেতৃত্বের বিকাশ ঘটানোর তাগিদে ২০১০ সাল থেকে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে স্টুডেন্ট কাউন্সিল নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিলো। এর ফলে শিক্ষায় শিশুর অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে এবং বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার পর্যায়ক্রমে কমে ৪৭.২৫% থেকে ১৩.৯৫% এ নেমে আসে।

কোভিড-১৯ চলাকালীন পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজেশনের আওতায় এনে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ধারবাহিকতা বজায় রেখেছেন। প্রায় প্রতিটি স্কুলে আইসিটি ল্যাব চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৬ষ্ঠ শ্রেণি হতে কম্পিউটার কোর্স বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সুষ্ঠুভাবে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম পরিচালনার লক্ষ্যে শিক্ষকদের আইসিটি ও পেডাগজি সমন্বয়ের প্রশিক্ষণ, বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণসহ নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

২১ শতকের নানবিধ চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তার টেকসই ও কার্যকর সমাধান এবং সম্ভাবনার পূর্ণ সুফল গ্রহণের জন্য অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জ্ঞান, দক্ষতা, ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন দূরদর্শী, সংবেদনশীল, অভিযোজন-সক্ষম, মানবিক এবং যোগ্য বিশ্ব-নাগরিক গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ প্রণয়ন করা হয়েছে ।

দেশব্যাপী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে দক্ষ ও সৃষ্টিশীল মানব শক্তি তৈরিতে সর্বশক্তি নিয়োগ, উচ্চশিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধির জন্য হাইয়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহেনসমেন্ট প্রজেক্ট গ্রহণ, অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল গঠন তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। শুধু সাধরণ বা প্রযুক্তি শিক্ষা নয়  শেখ হাসিনার সরকার মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে মাদ্রাসা কাঠামোতে বিজ্ঞান ও কম্পিউটার শাখা চালু করেছে। স্থাপিত হয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর ও ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়। দাওরা হাদিসকে মাস্টার্স সমমান প্রদান করে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসারে বর্তমান সরকার তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি কওমি মাদরাসার শিক্ষা ব্যবস্থার সরকারি স্বীকৃতি কার্যকর করেছেন। অথচ ইতোপূর্বে কোনো সরকারকেই কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি তেমন গুরুত্ব দিতে দেখা যায়নি।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর পরিবারসহ নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বিভিন্ন সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেও শিক্ষা বিস্তারে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেনি। অধিকন্তু তৎকালীন বিএনপি সরকার ১৯৮১ সালে সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো বেসরকারিকরণ করার উদ্যোগ গ্রহন করে। যদিও শিক্ষকদের জোরদার আন্দোলনের ফলে বিএনপি সরকার তাদের দুরভিসন্ধি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। অন্যদিকে ২০০৫ সালে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্যের আন্দোলনে অনেক শিক্ষককে গ্রেফতার করে হাজতে পাঠানো হয়। কাজেই সবদিক বিবেচনায় একথা বলা যায় যে, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তনের অগ্রযাত্রা, শিক্ষার মানোন্নয়ন ও প্রসারে আওয়ামী লীগ সরকারের অবদান অনস্বীকার্য।

লেখক: চেয়ারম্যান, শিক্ষা বিভাগ ও ডিন, শিক্ষা বিজ্ঞান অনুষদ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।