ধ্রুব হাসান

রিকশাচালক আব্দুল জব্বার ভাবেননি এত যন্ত্রনা নেমে আসতে পারে জীবনে। দিনভর রিকশা চালিয়ে ঘরে ফিরবেন হাসি মুখে, এটুকুই ছিলো আশা। সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছিলেন। তার বড় ভাইয়ের পরামর্শে পরিবারকে পাঠিয়ে দেন নারায়ণগঞ্জে কাজের উদ্দেশ্যে। সেদিন সকালে কত স্বপ্ন বুনছিলেন। সারাদিন রিকশা চালিয়ে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে রাতে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসে রওনা হলে যাত্রাবাড়ী এলাকায় আগুন সন্ত্রাসের কবলে পড়েন তিনি। আর নিমিষেই ঘুরে দাঁড়ানোর সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার।রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের বিছানায় এখন কস্টের দিন গুনছেন তিনি। তার শরীরের ২০ শতাংশ পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এই শতাংশের হিসাব তিনি বুঝেন না। কেবল মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে- মাগো।

খবরে জানা যাচ্ছে, জব্বারের মতো বিএনপি ও সমমনাদের ডাকা চলমান অবরোধে আগুনে পুড়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে চিকিৎসাধীন আছেন সাতজন। তারা সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ। কেউ পেশায় গার্মেন্টস শ্রমিক, পরিবরহন শ্রমিক কিংবা দিনমজুর। কী দোষ তাদের? অবরোধে রাস্তায় নেমেছেন কাজ করতে? কী দোষ তাদের? কাজে না নামলে পেটে ভাত জুটবে না? আগুন সন্ত্রাসের কবলে পড়ে যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা কেউই শংকামুক্ত নন বলে জানিয়েছেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা সামন্ত লাল। তারা শরীর পুড়ে যাওয়ার যন্ত্রনা নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করছেন- এর পরে আবার কবে কাজে নামতে পারবেন।

এই হতভাগাদের দেখতে গিয়ে কথা হয় তাদের সঙ্গে। তারা অবরোধ বুঝে না, তারা ক্ষমতা বুঝে না, তারা কেবল জানেন বেঁচে থাকতে হলে কাজ করতে হবে। এই কাজ করতে গিয়ে কেনো তাদের এমন হলো?

গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ কর্মসূচিকে ঘিরে সংঘর্ষের পর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এরপর থেকে হরতাল এবং দফায় দফায় ডাকা অবরোধে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, পেট্রোল ঢেলে আগুন দেওয়া শুরু হয়। ফায়ার সার্ভিসের হিসাবে ২৮ অক্টোবর থেকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৫০টিরও বেশি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। বাসে আগুনের ঘটনায় একজন পরিবহনকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন।

যাত্রাবাড়ীতে গত শনিবার (১১ নভেম্বর) রাতে অনাবিল পরিবহনের বাসে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে বাসযাত্রী দগ্ধ রিকশা চালক আব্দুল জব্বার ও গার্মেন্টেস কর্মী মাহমুদ হাসান দগ্ধ হন। চলেন শুনিনজব্বারের বড় ভাই জিকরুল ইসলাম কী বলেন- জব্বার রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতে পারতো না। সংসারে অভাব। তাই শনিবার  তার পরিবারকে কাজের উদ্দেশ্যে সকালে আমার বাসায় নারায়ণগঞ্জ নিয়ে আসি। জব্বার তার কাজ শেষ করে রাতে আমার বাসার উদ্দেশে বাসে চড়ে। পথে যাত্রবাড়ীতে আগুনে দগ্ধ হয়। সব কস্ট গরিবের। আমরা গরিব মানুষ নিজের সংসার চালাতে পারি না আর এখন এই চিকিৎসা সেই খরচ।

পুড়ে যাওয়া যাত্রী মাহমুদুল হাসান অনেক ট্রমার মধ্যে আছেন। সে সময়টা মনে করতেও যেন ভয় লাগে। তিনি বলেন, আমার এক বন্ধুর মোবাইল ফোন কিনতে বসুন্ধরা মার্কেটে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে তাকে দিয়ে কমলাপুর থেকে বাসে উঠে মাঝামাঝি বসেছিলাম। যাত্রাবাড়ী এলাকায় বাসটি আসার পর হঠাৎ দেখি আমার পায়ের নিচ দিয়ে আগুন লেগে গেছে। পরে দ্রুত ওই সিট থেকে কোনরকমে বের হয়ে যাই। ততোক্ষণে আমার দুই পা ও ডান হাত ঝলসে গেছে।

অন্যান্যদিনের মতোই রমজান পরিবহনের বাস চালক সবুজ মিয়া অছিম পরিবহনে করে বাসা থেকে কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলেন। পথে মেরাদিয়া বাঁশপট্টির কিছু আগে কীভাবে আগুন লাগিয়ে দিলো মনে করতে পারেন না।  তাকে উদ্ধার করে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে নিয়ে আসা হয়। শরীরে পোড়া ক্ষত নিয়ে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের শয্যায় এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাতরাচ্ছেন সবুজ মিয়া।

আগুনে পুড়ে হতাহতরা হয়েছেন পোষাক শ্রমিক মো: মাহমুদ হাসান (২৩), মেরাদিয়ার পরিবহন শ্রমিক সবুজ মিয়া (৩০), কালীগঞ্জে কাভার্ডভ্যানে অবস্থানরত বিপ্রজীদ ভাওয়ালী (২০), কাকরাইলে শ্রমিক শাখাওয়াত হোসেন (২৮), ডেমরায় বাসে ঘুমন্ত থাকা হেলপার মো. রবিউল ইসলাম রবি (২৫) এবং মানিক দাস (৪৫) নামে বিমানের এক ক্লিনার। আরও অনেকে এসে চিকিৎসা নিয়ে ফিরেছেন।

কথা হয় যাদের সাথে তারা প্রত্যেকে বলেন, কোথা থেকে কেমন করে আগুনে পড়লেন জানেন না। তবে ডাক্তাররা বলেছেন পেট্রোলে দগ্ধের কারণে তাদের শরীরে ক্ষতগুলো গভীর। তাদের কারো কারো অপারেশনের প্রয়োজন হচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেকের চামড়া লাগাতে হচ্ছে। শরীর কেবল জলে, কান্না বের হয়ে আসে অজান্তে। তারা জানতে চান তাদের কান্না কারোর কানে পৌঁছে কিনা? তাদের প্রশ্ন – কতটা বর্বর হলে একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাদের এই প্রশ্নের জবাব কে দিবে?

পুড়ে যাওয়া স্বজনেরা হাসপাতালের বারান্দায় বসে অপেক্ষা করছ্ন কখন তাদের সংসারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি সেরে উঠবেন। তারা বলছেন রোজগার বন্ধ থাকায় বাধ্য হয়ে স্বজন আর পরিচিতজনদের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। কবে সুস্থ হয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে নিতে পারবেন এবং আয়ে ফিরবেন সেই দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন স্বার্থপরের মতো।

আসলেই কি স্বার্থপর বলা যাবে তাদের? আমরা কি ভুলে যাব গত অক্টোবর ভোরে ডেমরার দেইল্লা বাস স্টেশনে রাস্তার পাশে রাখা অছিম পরিবহনের বাসে আগুন লাগায় পুড়ে যাওয়া হেলপার নাঈমকে? হয়তো ভুলে যাব। কিন্তু যারা ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকবেন তারা ভুলবেন না। ভুলবেন না হুট করে কীভাবে সব এলোমোলো করে দেওয়া হয়েছে তাদের জীবন। ওদের কান্না বিএনবি জামাতের দুর্বৃত্তদের কানে পৌঁছায় না। এই দিনগুলো কেবল খেটে খাওয়া নিরাপরাধ মানুষের কান্না হয়ে জমে থাকবে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।