ড. খালেদ মাহমুদ

বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ধর্মঘট এবং অবরোধের কারণে নানান সমস্যা দেখা যায়। এসব সমস্যা সাধারণ জনগণের উপর উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব ফেলছে। প্রায়ই রাজনৈতিক বিরোধ, অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক উত্তেজনার ফলাফল সূদূঢ়প্রসারী হয়।

নাগরিকদের মঙ্গলের জন্য এসব দাবি করা হলেও কৌশলগত দুর্বলতার কারণে মারাত্মক প্রভাব ফেলে জনজীবনে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কাজে ব্যাঘাত ঘটে। ধর্মঘট ও অবরোধ পরিবহন ব্যবস্থাকে অচল করে দেয়। যার প্রভাব পরে অর্থনীতিতে।

এমন কি যারা সকালে কর্মস্থলে যাচ্ছে, তারা যে দলই করুক না কেন, হরতালের কারণে সংকটের মুখে পড়ে। সাধারণ জনগণের যাতায়াতের ক্ষেত্রে মারাত্মক অসুবিধা দেখা যায়। রাস্তা অবরুদ্ধ হলে নগরজীবনে নানান ভোগান্তি দেখা যায়। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ হয়ে গেলে অসংখ্য মানুষের কাজে সমস্যা হয়। এই সমস্যা যেমন মানবিক, তেমনি আর্থিক।

হাজার কোটি টাকার ক্ষতি

হরতাল অবরোধের কারণে সাধারণ কলকারখানা বন্ধ রাখেন মালিকেরা। এতে কত শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয় তা নিয়ে গবেষণার সুযোগ আছে। ২০১৩ সালে ঢাকা চেম্বারের হিসাবে, পাইকারি বাজার, শপিং মল, শোরুম, ক্ষুদ্র্র ও ছোট দোকান প্রতিদিন ৬০০ কোটি আর বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির দাবি, হরতালে দেশের ২০ লাখ দোকানে প্রতিদিন ক্ষতি হয় ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা। ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির হিসাবে, হরতালের দিন দিনের বেলায় সারা দেশে গড়ে কমপক্ষে সাড়ে তিন লাখ বাস-মিনিবাস ও ট্রাক চলাচল বন্ধ থাকে। এ কারণে ওই সব দিন অন্তত ২৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এই পরিসংখ্যান ২০১৩ সালের, সেই হিসেবে ২০১৩ সালে ক্ষতির পরিমাণ আরও ৩০ গুণ বেশি ধরে নিতে পারি আমরা।

২০১৩ সালের তথ্য বলছে, এফবিসিসিআইয়ের হিসাবে, এক দিনের হরতালে দেশের জিডিপির দশমিক ১২ শতাংশ ক্ষতি হয়। ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশের (আইসিসিবি) হিসাবে, এক দিনের হরতালে এক হাজার ৫৪০ কোটি টাকার (২০ কোটি ডলার) ক্ষতি হয়। হরতালে ক্ষতির একটি হিসাব করেছে ঢাকা চেম্বারও।

সংগঠনটির হিসাবে, এক দিনের হরতালে দেশের এক হাজার ৬০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। বছরে গড়ে ৪০ দিন হরতাল হয়। সে দিক থেকে হরতালে এক বছরে ক্ষতি হয় ৬৪ হাজার কোটি টাকা।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর হরতালের কারণে যে ক্ষতি হয়েছে, তা বাংলাদেশের জিডিপির ৪ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশের সমান। বাংলাদেশের হরতাল নিয়ে ২০০৫ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) গবেষণায় বলা হয়, ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর হরতালের কারণে দেশের জিডিপির ৩ থেকে ৪ শতাংশের সমান আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) তথ্য অনুসারে ২০১৫ সালের হিসেবে অবরোধ-হরতালে প্রতিদিন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হয় ২ হাজার ২৭৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।)। এক কথায় বলা যায়, ক্ষতির অংক অনেক বড়।

রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় অর্থনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যাপকভাবে খেয়াল করা যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিশেষ করে ছোট উদ্যোগ ও মাঝারি ধরণের উদ্যোগ ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও বাধার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

দৈনিক মজুরি নির্ভর শ্রমিক ও ছোট ব্যবসার মালিকদের আর্থিক ক্ষতি পরিবারগুলিকে আর্থিক কষ্টের মধ্যে ঠেলে দিতে পারে। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হয়। বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল পরিবেশে বিনিয়োগ করতে দ্বিধায় থাকে। সামগ্রিকভাবে বিদেশী ও দেশীয় বিনিয়োগ হ্রাস পায়।

শিক্ষাখাতের যত সংকট

রাজনৈতিক অস্থিরতায় উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া আরেকটি খাত হচ্ছে শিক্ষা। ধর্মঘট বা বিক্ষোভের সময় স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে একাডেমিক ক্যালেন্ডার ব্যাহত হয়। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পড়াশোনা ও ফলাফল প্রভাবিত হচ্ছে।

আগামী নির্বাচন উপলক্ষ্যে ২০২৩ সালের শেষ দুটি মাস বেশ ঘটনাবহুল হবে বলা যায়। আবার নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাস কিন্তু বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার মৌসুম। আমরা দেখছি, প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব স্তরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা থাকে এ সময়ে।

প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষা, এসএসসি বা পাবলিক পরীক্ষার টেস্ট পরীক্ষা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা, একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষা থাকে, বা এই সময়ে ভর্তির মৌসুম শুরু হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের তিন কোটি ৭০ লাখ শিক্ষার্থী আর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য এই সময় বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

শিক্ষাবর্ষের বড় একটি সময় ক্লাস করতে না পারার ঝুঁকিতে থাকে শিক্ষার্থীরা। আগেও আমরা দেখেছি হরতাল-অবরোধের কারণে শিক্ষাব্যবস্থা চরম হুমকির মুখে পড়ে। হরতালের কারণে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাস মিস স্বাভাবিক। হরতালের কারণে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতি ব্যাহত হয়।

২০১৪ সালে দেখা যায় ছুটি ও হরতাল-অবরোধের কারণে ২০৮ দিন ক্লাসে শিক্ষার্থীরা আসেনি। হরতাল-অবরোধ যদি সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য তাহলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বিষয়টিকে মাথায় রাখা প্রয়োজন কিন্তু।

পরিশেষে বলতে চাই, হরতাল বা অবরোধের মত রাজনৈতিক মাধ্যম সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। এই বিষয়গুলো অনেক সেনসেটিভ বিষয়।

এখন ২০২৩ সাল, ১৯৮৩ সালের বাংলাদেশ কিংবা পৃথিবী নেই। পৃথিবী সামনে এগিয়েছে, রাজনৈতিকভাবেও আমরা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বিকল্প ও আরও কার্যকর রাজনৈতিকভাবে অধিকার আদায়ের কৌশল খোঁজা প্রয়োজন সব রাজনৈতিক দলের।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।