বিশ্বজিৎ দত্ত
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস যেন কূটনীতিকের আড়ালে এক ‘অতি-মানব’ হয়ে উঠেছেন। শনিবার রাজধানী ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে বিএনপির মহাসমাবেশকে ঘিরে সহিংসতার পর এখন সর্বত্র আলোচনার টেবিলে জায়গা করে নিয়েছেন পিটার হাস। সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক কর্মী, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম কর্মী সবার মুখে মুখে একটাই আলোচনা ‘হাস’ বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চান? কেন তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে অযাচিত হস্তক্ষেপ করে অস্থিতিশীল করে তুলেছেন? বিএনপির সঙ্গে তার এতো দহরম-মহরমের নেপথ্যে কি? তিনি কি তার পূর্বসূরী হেনরী কিসিঞ্জারকে অনুসরণ করছেন? তার উদ্দেশ্য কী বাংলাদেশে আরেকটা ১৫ আগস্ট তৈরি করা? ২১ শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামী তারেক রহমানের সঙ্গে তার কিসের সম্পর্ক? -এরকম আরো বহু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ঢাকা তথা গোটা দেশের মানুষের মনে।
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ছিল বাংলাদেশের জন্য এক ভয়ঙ্কর দিন। আজও মানুষের মনে ঘুরে ফিরে সেই দিনের কথা উঠে আসে রাজনীতির নানা আলোচনায়। গতকাল ২৮ অক্টোবর (শনিবার) রাজধানীতে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, বিভিন্ন এলাকায় জ্বালাও-পোড়াও, সাংবাদিক নির্যাতন, পুলিশ হত্যাসহ যে তাণ্ডব চালিয়েছে বিএনপি ও তার সহযোগি সংগঠন সেটি ছিলো ২০০৬ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
বিএনপি গত প্রায় এক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে সারাদেশে সরকার বিরোধী আন্দোলন করে আসছে। দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া এই সময়ে দেশের কোথাও কোনো বড় ধরণের সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। এমনকি গত ১৮ অক্টোবর রাজধানীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে যুবদলের যে সমাবেশ ছিলো সেটিও ছিলো শান্তিপূর্ণ। তাহলে শনিবার কেন বিএনপি হঠাৎ করে এতো বেপরোয়া হয়ে উঠলো? কেন এতো নৈরাজ্য চালালো? হঠাৎ করেই কেন জ্বালাও-পোড়াও হত্যায় মেতে উঠলো? এই প্রশ্নগুলো এখন সবার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
যে বিএনপি সমাবেশের আগের দিনও বললো সমাবেশ হবে শান্তিপূর্ণ, সেই বিএনপি কেন এতো হিংস্র হয়ে উঠলো? টার্গেট করে তারা কেন প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা চালালো? কেন তারা পুলিশের ওপর হামলা চালালো, পুলিশ সদস্যকে টার্গেট করে হত্যা করলো? কেন সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালালো? কেনই বা তারা হাসপাতালের মত স্পর্শকাতর জয়াগায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করল? এতো সাহস কোথায় পেল বিএনপি?
রাজনীতি সচেতনরা বলছেন, বিএনপির এতো সাহসের নেপথ্যে একজন। তিনি আর কেউ নন, ‘পিটার হাস’। যিনি গত কিছুদিন ধরে বিএনপি-জামায়াত জোটের পক্ষ নিয়ে বেপরোয়া ভাবে, ভিয়েনা কনভেশন অমান্য করে নির্লজ্জের মত বাংলাদেশের রাজনীতিতে নাক গলাচ্ছিলেন। তার এই উন্মুক্ত আচরণ বাংলাদেশকে অস্থির করে তুলেছে বলে মনে করছেন দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সব শ্রেণি পেশার মানুষ। তারা বলছেন, বিএনপি যতোটা না সাহস করেছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি তৎপর হয়ে পিটার হাস-ই বিএনপিকে নৈরাজ্য করার পরামর্শ দিয়েছেন।
পিটার হাস যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত জঙ্গি জোটের পক্ষে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন তার অনেকগুলো উদাহরণ আছে সাম্প্রতিক সময়ে। গত ২২ অক্টোবর পিটার হাস স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে বৈঠক করেন। কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেন, ২৮ অক্টোবরের আগে যেন সরকার যানবাহন বন্ধ না করে! বিএনপি নেতাকর্মীদের ঢাকার সমাবেশে যোগ দেয়ার ক্ষেত্রে যেন কোনোরকম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা না হয়। এ নিয়ে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে সংবাদও প্রকাশিত হয়। অনেকেই প্রশ্ন তুলেন, পিটার হাস কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এরকম বলতে পারেন? এটা কি কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত নয়?
এর বাইরে গত কয়েক মাস ধরেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানাভাবে তৎপর রয়েছেন মার্কিন এই রাষ্ট্রদূত। তিনিই সব জায়গায় প্রভাব বিস্তার করে বাংলাদেশ সরকারকে নানাভাবে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছেন। সরকারের কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। আবার সরকার বিরোধী শক্তি বিএনপি-জামায়াত জোটকে ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছেন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য। বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সময়ে অসময়ে, প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে তিনি নিয়মিত বৈঠক করছেন। সর্বশেষ বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মালিকের বাসায় ডিনার করতেও যান পিটার হাস। যেখানে বিএনপি জামায়াতের অনেক নেতা উপস্থিত ছিলেন।
এর বাইরে লন্ডনে অবস্থানরত ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গেও পিটার হাসের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে বলে শোনা যায়। সব মিলিয়ে পিটার হাসই বলতে গেলে বিএনপি-জামায়াত জোট পরিচালনা করছেন। যা একেবারেই ভিয়েনা কনভেনশনের সুষ্পষ্ট লঙন এবং কূটনৈতিক শিষ্ঠাচার বহির্ভূত।
আমাদের মনে আছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। শুধু তাই নয়, সপ্তম নৌবহর বা রণতরী পাঠিয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত তারা পিছু হটেছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এক কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। সেই কালো অধ্যায়ের সঙ্গেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিবিড় সম্পর্ক ছিলো। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার, ঢাকার মার্কিন দূতাবাস সক্রিয় ছিলো বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে।
আজকের বাংলাদেশের রাজনীতিতেও পিটার হাসের তৎপরতা দেখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামনে চলে আসে। পিটার হাস এতোটাই তৎপর হয়ে উঠেছেন যে, তার অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি সহিংস রূপ ধারণ করেছে। এক বছর ধরে যে দলটি শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ, রোড মার্চ, জেলা-মহানগরীতে সমাবেশ করেছে। প্রায় প্রতিদিনই সারাদেশে কোথাও না কোথাও দলের কর্মসূচী পালন করেছে শান্তিপূর্ণভাবে, সেই বিএনপি ২৮ অক্টোবর শনিবার কেন দানবে রূপ নিলো- তার হিসাব মিলাতে পারছেন না কেউ। এমনকি বিএনপির নেতাকর্মীরাও এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাচ্ছেন না।
সবার একটাই প্রশ্ন- তাহলে কি বিএনপির নেতৃত্বকে নাটাই দিয়ে ঘুরিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে পিটার হাস-ই রাজনৈতিক অঙ্গনকে অস্থির করে তুললেন? তার এই কর্মকাণ্ড এবং অপতৎপরতা যে শুধু শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশের রাজনীতিকে অস্থির ও সহিংস করে তুলেছে তা নয়, খোদ বিএনপিকেও রাজনীতির মাঠ থেকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে। গত এক বছরে বিএনপি নেতৃত্ব যেভাবে দলকে চাঙ্গা করেছিল, মিছিল-মিটিং সমাবেশের মধ্য দিয়ে দলের মধ্যে প্রাণ ফিরিয়ে এনেছিল, ২৮ অক্টোবরের ঘটনা যেন বিএনপিকে মুহুর্তেই গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর আগেও আমরা বিদেশীদের নাক গলাতে দেখেছি। এমনকি জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের প্রতিনিধিকেও দেখেছি বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে রাজনৈতিক অস্থিরতা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারা কোনো সময় কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করেননি। পিটার হাসের মতো এতো খোলামেলাভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেননি। পিটার হাস সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি যেন পুরো বাংলাদেশের রাজনীতিন নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে চান। তার গত কয়েক মাসের তৎপরতায় এমনটাই মনে হয়েছে। সঙ্গত কারণেই এটা স্পষ্ট যে, বিএনপি যে তাণ্ডব শনিবার রাজধানী জুড়ে চালিয়েছে তাতে পিটার হাসই নাটের গুরু।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী।