বিপ্লব কুমার পাল
সবার মনে প্রশ্ন ছিলো- কী হতে চলেছে ২৮ অক্টোবর? বিএনপি মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু পরবর্তী কর্মসূচির কোন আঁচ ছিলো না। তবে দলটির মহাসচিব বারবারই বলছিলেন- রাজধানী ঘেরাও কিংবা রাস্তায় অবস্থান নেওয়ার কোন কর্মসূচিতে তারা যাবেন না। কিন্তু ২৮ তারিখ দুপুরের পরপরই বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট। রণক্ষেত্রে হয়ে ওঠে রাজধানী ঢাকার কিছু এলাকা। কাকরাইল, বিজয়নগর, আরামবাগ, পল্টন এলাকার ভিডিও বিশ্লেষণের দেখা যায় কোথাও কোন উস্কানি ছিলো না। বিএনপি কর্মীরা টার্গেট করেছে পুলিশ এবং গণমাধ্যমকর্মীদের। দিনশেষে খবর আসে- এক পুলিশ নিহতসহ ৪১জন পুলিশ আহত, ২৮জন গণমাধ্যমকর্মী আহত। প্রশ্ন হলো- কোন শক্তি বলে সহিংস হলো বিএনপি?
এটা এখন স্পষ্ট বিএনপি কার শক্তিতে নিজেকে বলিয়ান ভাবতে শুরু করেছিলো। গুলশানে লেকশোর হোটেলে বিএনপির উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দেশীয়-আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে এমন মন্তব্য করেন দলটির নেতারা। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বলেন, ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি আমাদের জন্য অবতার হয়ে এসেছেন। তার তো আমাদের আরো সাহস দেয়া দরকার, বাবারে তুই আমাদের বাঁচা, রক্ষা কর। তার বলতে হবে- আমি আছি তোমাদের সঙ্গে, তোমরাও ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি আমরাও ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি। পিটার হাস- বাবা ভগবান আসালামু আলাইকুম’।
বিএনপি যখন ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে ঠিক তখনই এই ’অবতার’ ২২ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান। বৈঠক শেষে মন্ত্রী জানান, বিএনপির সমাবেশে সরকার সড়কে কোনো বাধা দেবে কিনা সেব্যাপারে রাষ্ট্রদূত জানতে চেয়েছেন। জবাবে তিনি জানিয়েছেন সরকারের এমন কোনো পরিকল্পনা নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বৈঠকে তিনি (পিটার হাস) জানতে চেয়েছেন বিএনপি যে একটি বিরাট কর্মসূচি দিয়েছে সেখানে অনেক লোক নিয়ে আসবে, সরকার রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেবে কি না, কিংবা তোমরা অন্য কিছু করবা কিনা। আমরা বলেছি, ওই ধরনের কোনো প্রোগ্রাম আমাদের নেই। আমরা মনে করি, তারা যে রাজনৈতিক এজেন্ডা দিয়েছেন, তারা শান্তিপূর্ণভাবে করবেন। কর্মসূচি যদি তারা শান্তিপূর্ণভাবে পালন করেন, তবে আমাদের কিছু বলার নেই।’
বিএনপির কর্মসূচি নিয়ে সরকার কী ভাবছে সেটা মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে পিটার হাস গিয়ে জানতে চাওয়া স্বাভাবিক কোন বিষয় নয়। নিজেদের কর্মসূচি নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এই নড়াচড়াকে নিজেদের শক্তির জায়গা হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে বিএনপি। এই শক্তি আজকের না। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর বিচার বন্ধে আন্তর্জাতিকভাবে যে অপতৎপরতা শুরু হয় তাতে কয়েকটি নাম ঘুরেফিরে এসেছে, যার অন্যতম যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রিক লবিস্ট ফার্ম রাস্কি পার্টনারস। রাস্কি পার্টনারসের সঙ্গে মেনেনডেজের সম্পর্কের বিষয়টি গোপন কিছু নয়। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আর্থিক লেনদেনের তথ্য প্রকাশকারী ওয়েবসাইট ওপেনসিক্রেট-এর প্রকাশিত তালিকায় রাস্কি পার্টনারসের কাছ থেকে মেনেনডেজের ২৩ হাজার ডলার গ্রহণের উল্লেখ রয়েছে। রাজনীতি ও আইনি লড়াইয়ের জন্য মেনেনডেজের যে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয় সেজন্য তিনি সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল রাস্কি পার্টনারসের কর্নধার ল্যারি রাস্কির ওপর। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, পিটার হাসকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দানের ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছেন বব মেনেনডেজ।
কিছু সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা ছাড়া, কেনো পিটার হাসকে বাংলাদেশে পাঠাতে এতো ব্যস্ত হয়ে উঠবেন মেনেনডেজ। আর দেশে আসার পর থেকে একটার পর পদক্ষেপ নিয়ে নিয়োগের দায় পূরণে ব্যস্ত পিটার হাস। একটা দেশে বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া কয়েকজনের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছেন তিনি। সেটি তাদের বাসায় গিয়ে। এরমধ্যে সদ্য যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির প্রয়োগ শুরু হওয়া। এর মধ্য দিয়ে বিএনপির জন্য চূড়ান্ত আন্দোলনের রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা।
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ যখন নির্বাচনের দিকে এগিয়ে চলেছে তখন সেই নির্বাচন বানচালের নানা পরিকল্পনার সাথে জড়িত দল বিএনপির সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ রেখে চলেছেন পিটার হাস। এরইমধ্যে ১২ অক্টোবর ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গুলশানের আমেরিকান ক্লাবে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বলে বিএনপি সূত্র নিশ্চিত করলেও ফখরুল ইসলাম তা স্বীকার করেননি। বৈঠক করেও এই অস্বীকারের ঘটনা আরও সন্দেহের উগ্রেক করে।
ঘটনা পরস্পরা ও বিশ্লেষণ বলে বিএনপিকে পিটার হাস তার শক্তিতে বলিয়ান করায় ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ ও আশেপাশের স্থলে সহিংসতা ছড়িয়ে দেয় দলটি। গত একবছর ধরে রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ এবং প্রকাশ্য বিবৃতি সহজভাবে দেখার কোন অবকাশ নেই। সরকার একদিকে মনে করছে, দেশের মধ্যে যখন চাপ তীব্র হচ্ছে না। ফলে পরিস্থিতি থেকে উৎরে যাওয়া সম্ভব। বিরোধী পক্ষ কিছুই করতে পারবে না। যদিও ভিসা স্যাংশন এরমধ্যেই আমেরিকা কার্যকর রেখেছে। এমন স্যাংশন আরও বর্ধিত আকারেও আসতে পারে। এমন অবস্থায় দেশের ক্ষতি কী হবে, এ নিয়ে ভাবার আগে ক্ষমতায় ঠিকে থাকাটাকে জরুরী মনে করছে সরকার পক্ষ। আর বিরোধী পক্ষ মনে করছে চাপ দিয়েই যা করার করে নিতে হবে।
লন্ডনে অবস্থান করা নেতার সরাসরি নির্দেশেও দলের সব পর্যায়ের কর্মী সংগঠকরা কোন শক্ত আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন পিটার হাসের কাছে। কিন্তু ২৮ অক্টোবর কিছু হবে না বলেও একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। যার শক্তিতেই বলিয়ান হয়ে বিএনপি সহিংসতা করুক না কেনো মানুষ এই সহিংসতা চায় না। এবং ২৮ অক্টোবরের সহিংসতা যে বিএনপির একার করা এবং মাঠে সরকারদলীয়দের যে অবস্থান ছিলো না সেটা স্পষ্ট হয়েছে। একইসঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীকে টার্গেট করে আঘাত করার কারণেও এটি স্পষ্ট যে, তাদের এই একপাক্ষিক রাজপথের সহিংসতা যেনো প্রমাণ আকারে না থাকে সেটির প্রমাণ। কিন্তু একবছর ধরে পিটার হাসের পরিকল্পনা ও একের পর এক বৈঠক করে চলা বিএনপির ‘অসহিংস’ মুখোশ খুলে যাওয়ায় খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে- আসলে কি শেষরক্ষা হবে? অবতার তাদের আবারও সহিংস করে তুলে জনগনের কাছ থেকে সরিয়ে নিচ্ছে নাতো? বিএনপি ভাববে নিশ্চয়।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।