মিনার সুলতান

২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে রাজনৈতিক আলোচনা এখন তুঙ্গে। বিএনপি দিচ্ছে শক্তিপ্রদর্শনের মাধ্যমে সরকার উৎখাতের হুমকি, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বলছেন – সহ্যসীমা শেষ, এবার পাল্টা আঘাত। আবার গোয়েন্দা সংস্থা জানাচ্ছে, এই সমাবেশকে ঘিরে বড় ধরনের হামলার পূর্বাভাসের কথা। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে। আসলে কী হতে যাচ্ছে ২৮ অক্টোবর? সরকার কী পারবে পরিস্থিতি সামাল দিতে? একটি সূত্র জানাচ্ছে, প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা এবার প্রস্তুত ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বদলা নিতে!

মার্কিন দূতাবাসের গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের বরাত দিয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানাচ্ছে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট হত্যাযজ্ঞের বদলা নিয়ে বিএনপিকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে মরণকামড় দেওয়ার পরিকল্পনা করছে বিএনপির আমলে নিপীড়িত আওয়ামী লীগ নেতারা। এরই অংশ হিসেবে এই সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা করছে আওয়ামী লীগের একাংশ।

সরিজমিন প্রতিবেদন বলছে, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের এতোদিনের নমনীয় অবস্থান এখন আমূল বদলে গেছে। গত দেড় দশক যেভাবে ছাড় দিয়েছে তারা, সেই দয়ার্দ্র ভাব আর দেখাতে রাজি নয় আওয়ামী লীগের পোড় খাওয়া নেতাকর্মীরা। বিএনপি নেতাদের উপর্যুপুরি হুমকির মুখে এবার তারা প্রতিশোধের পথে হাঁটার প্রস্তুতি নিচ্ছে ভেতরে ভেতরে।

মহানগরের শীর্ষ নেতারা বলছেন, সব সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছেন বিএনপির সন্ত্রাসবাদী নেতানেত্রীরা। তাই তাদের উপর্যুপুরি হুমকি ও নাশকতার মুখে বারবার অতীতে নির্যাতনের শিকার হওয়ার স্মৃতি ফিরে আসছে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের স্মৃতিতে। শরীরে নির্যাতনের জখম ও স্বজন হারানোর স্মৃতি বয়ে বেড়ানো জীবনে এবার প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠছে। আর কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বিএনপির দুর্বৃত্তদের।

২১ আগস্ট বর্বর হত্যাযজ্ঞের বদলা নিতে চায় দলের একটি অংশ:

আওয়ামী লীগের জনসভায় প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রেনেড হামলা ও এলোপাথারি গুলি, রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় নেতাকর্মীদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। হতাহতদের আর্ত-চিৎকারে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। ১৯ বছর আগের সেই বীভৎস স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। কিন্তু আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কখনো প্রতিশোধের পথে আগায়নি দলটি। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। বিএনপি নেতাদের সহিংস আস্ফালন এবং হত্যা-নাশকতার উপর্যুপুরি হুমকির মুখে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। ২৮ অক্টোবরকে কেন্দ্র করে প্রতিশোধের দাবি উঠছে দলটির নির্যাতিত নেতাকর্মীদের মুখে।

বিএনপি নেতাদের নাশকতার হুমকি ও সহিংস বক্তব্যই কী তাহলে শরীরে স্পিন্টারের ব্যথা বয়ে বেড়ানো পাঁচ শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর মনের আগুনকে উস্কে দিচ্ছে? কেনইবা এতাদিন পর এসে প্রতিশোধের দাবি উঠছে দলটির ভেতরে? ২৮ অক্টোবর তাহলে কী করতে চায় বিএনপি, যা আওয়ামী লীগের ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের দীর্ঘ দেড়যুগের ক্ষতকে জাগিয়ে তুলছে?

মূলত ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। বিএনপি-জামায়াত জোটের এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে ২২ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীসহ ২৪ জন মানুষের মৃত্যু এবং আহত হয় পাঁচ শতাধিক। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বিশ্বস্ত নেতাকর্মীদের আত্মদানের বিনিময়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার শ্রবণশক্তি। সেই বর্বর হামলায় আহত পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীর মতোই ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গ নিয়েই আজ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অথচ এখনো তাকে এবং দলীয় নেতাকর্মীদের হত্যার হুমকি দিয়েই যাচ্ছে রাজনীতির ছদ্মবেশে থাকা বিএনপির দুর্বৃত্তরা। এমনকি ২৮ অক্টোবরে রাজধানীতে সমাবেশের নামে আবারো নাশকতার ছক আঁটছে বিএনপি, যা প্রকাশ্য হওয়ার পর এবার পাল্টা আঘাতে যাওয়ার জন্য দলীয় ফোরামে কথা তুলছে ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা।

বিএনপির নাশকতার নীল নকশা, তথ্য পেয়ে আওয়ামী লীগের পাল্টা আঘাতের প্রস্তুতি:

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মহানগর ও জেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গসংগঠনগুলোর যেসব বৈঠক হচ্ছে, সেগুলোতে নেতাকর্মীরা এবার বিএনপির সন্ত্রাস থেকে নিজেদের জান-মাল রক্ষার স্বার্থে পাল্টা আঘাতে যাওয়ার অনুমতি চাইছে। নেতাকর্মীরা বলছেন, ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের হুমকি দিয়েছিল বিএনপি। সেই লক্ষ্যে ঢাকায় সমাবেশের নামে সারাদেশ থেকে তাদের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদেরও নিয়ে এসেছিল তারা। এবারও ২৮ অক্টোবর সরকার উৎখাতের ঘোষণা দিয়ে সমাবেশের নামে সহিংসতা ও অস্থিরতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ভাড়াটে গুণ্ডাদের অস্ত্রসহ ঢাকায় সমবেত করছে বিএনপি। এমনকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকেন্দ্রিক নাশকতার প্রস্তুতিও নিচ্ছে তারা। ফলে তৃণমূল পর্যায়ে থেকে এদের প্রতিরোধের জন্য বারবার বার্তা পাঠানো হচ্ছে আওয়ামী লীগেরহাই কমান্ডে।

এবিষয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল নেতারাও বলছেন, অনেক সহ্য করা হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগের চব্বিশ হাজার নেতাকর্মীকে হতাহত, নিপীড়ন, নির্যাতন করেছে। অথচ আওয়ামী লীগ দেড় দশক সরকারে থেকেও বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর কোনো নির্যাতন করেনি। উল্টো বিএনপির লোকরাই সুযোগ পেলেই রাজনীতির ছদ্মবেশে সন্ত্রাসবাদ চালিয়েছে, পেট্রোল বোমা দিয়ে শত শত মানুষ হত্যা করেছে। গত এক বছরে বারবার তারা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ নেতাকর্মীদের হত্যা ও উৎখাতের হুমকি দিচ্ছে। এখন আত্মরক্ষার জন্য নেতাকর্মীরা উদগ্রীব হয়ে পড়েছে।

তারমধ্যে ২৮ অক্টোবরকে কেন্দ্র করে বিএনপি নেতাদের সরকারের উৎখাতের ঘোষণা এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতের শাপলা চত্বরে যুগপৎ সমাবেশের পরিকল্পনা এই সন্ত্রাসবাদী চক্রের নাশকতার নীল নকশাতেই প্রকাশ্য করে তুলেছে। ফলে এবার আগে থেকেই নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগাম ভ্যবস্থা এবং সহ্যসীমা অতিক্রম করায় আগের নির্যাতন ও ক্ষতির বদলা নিতে প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা।

বুমেরাং হয়েছে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের প্রতি হত্যার হুমকি: 

বিএনপি নেতাদের কথা ও কর্মের পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২২ সালের ৮ অক্টোবর, ঢাকার সেগুনবাগিচার এক সমাবেশে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান পেশীশক্তির মাধ্যমে সরকার পতনের ঘোষণা দিয়েছিল। সেদিন বিএনপির এই প্রভাবশালী নেতা বলেছিলেন, ‘আগামী ১০ ডিসেম্বরের পরে বাংলাদেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায়। এর বাইরে দেশ চলবে না কারো কথায়।’ অর্থাৎ, দেশের সরকার-সংবিধান-আইন সবকিছু ছুড়ে ফেলে সন্ত্রাসবাদ কায়েমের হুমকি দিয়েছিল সে।

২০২২ সালের ১১ অক্টোবর লক্ষীপুর জেলা বিএনপির সমাবেশে অবৈধভাবে সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে দেশের ক্ষমতা দখলের ঘোষণা দেন বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি। তিনি বলেন, ‘১০ ডিসেম্বরের আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। এরপর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশ পরিচালনা হবে।’ কোনো নির্বাচন ছাড়াই দেশের সরকার দখল করে দেশ পরিচালনার উচ্চাভিলাস ঘোষণা করেন এই বিএনপি নেতা।

এছাড়াও এই বছরের ২১ মে (২০২৩), রাজশাহীর সমাবেশে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করে কবরে পাঠানোর হুমকি দেন রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ ওরফে চাঁদ। এর পরদিন রাজধানীর নয়াপল্টনের সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও শেখ হাসিনার প্রাণনাশের বিষয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেন। এমনকি দলের যুগ্মমহাসচিব ও তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ নেতা রুহুল কবীর রিজভীও উপর্যপুরি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য দিতে থাকেন। ফলে স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শেখ হাসিনাকে নিয়ে যেসব আপত্তিকর বক্তব্য দেয় বিএনপি নেতারা, তা মূলত দলের কেন্দ্রীয় তথা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্দেশেই হয়ে থাকে।

উঁকি দিচ্ছে প্রতিশোধের রাজনীতি:

২৮ অক্টোবর বিএনপি-জামায়াত চক্রের সমাবেশের আড়ালে সন্ত্রাসবাদের হুমকির প্রতিবাদে এবার আগেই মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগের নিপীড়িত নেতাকর্মীরা। এমনকি যদি আর একটি সহিংস বক্তব্য দেওয়া হয় বিএনপির পক্ষ থেকে, তাহলে আত্মরক্ষার স্বার্থে পাল্টা আঘাত হানতে দ্বিধা করবে না আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের পোড়-খাওয়া কর্মীরা। এজন্য দলের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও গণমাধ্যমে বক্তব্য রেখে গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত দলীয় নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। এমনকি দেশের সাধারণ মানুষকেও নাশকতা এবং সহিংসতা প্রতিরোধে সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, ঐতিহাসিক ও রাজপথের দল হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা যদি সহ্যের খোলস ভেঙে ফের রাজপথে নেমে আসেন নির্বাচনের আগে, তাহলে সহিংস বিএনপি ও তার সঙ্গীরা কী প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার সামর্থ্য রাখবে নাকি ক্ষয়ে যাওয়া দল হিসেবে চোরাগোপ্তা হামলার মাধ্যমে আবারো সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষতি করবে? নাকি ২৮ অক্টোবর কোনো রক্তাক্ত অধ্যায় রচিত হবে, যার মাধ্যমে সূচিত হবে প্রতিশোধের রাজনীতি!

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।