বিশেষ প্রতিনিধি

গত ১৫ বছরে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরণের অগ্রগতি হয়েছে। কমেছে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা। বেড়েছে ভর্তির হার।

শতভাগ শিক্ষার্থীদের হাতে বছরের শুরুতে নতুন বই পৌঁছে দেওয়া, শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করতে শিক্ষা উপবৃত্তি ব্যবস্থা চালু করার মত সাফল্য আছে এই দেড় দশকে। প্রাক-প্রাথমিক কার্যক্রম চালু করা ছিলো একটা বড় সাফল্য। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১২ গুণ। শিক্ষার্থীর পাশাপাশি সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যাও বেড়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেয়া প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, শিক্ষার্থী বাড়ার  পাশাপাশি বছরের  পর বছর অবহেলিত প্রাথমিক শিক্ষার উন্নযনে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বিপুল সংখ্যক শিক্ষক। আগে যেখানে একটি বিদ্যালয়ের জন্য দুই থেকে তিন জন শিক্ষক ছিলেন সেখানে এখন শিক্ষক আছেন আনুপাতিক হারে। 

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০০৬ সালে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার হাল ছিল করুন। শিক্ষার্থী থাকলে শিক্ষক পাওয়া যেতো না। আবার কোনো কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষক আছেন তো, শিক্ষার্থী নেই। দেশের অনেক প্রত্যন্ত এলাকার বিদ্যালয়গুলোতে লেখাপড়া হতো না বললেই চলে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ইচ্ছামত যাওয়া আসা করতো। অনেক বিদ্যালয়ে মাঠ থেকে শুরু করে শ্রেণিকক্ষের বারান্দা এমনকি শ্রেণিকক্ষগুলোতেও ছিলো গরু-ছাগলের অবাধ যাতায়াত। শিক্ষার পরিবেশ ছিলো না।  খেলাধুল হতো না বললেই চলে। 

সব মিলিয়ে গত দেড় দশকে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার পরিবেশ ফিরে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী সারাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নেয়। এরই অংশ হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপন, নতুন শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ, ওয়াশব্লক, নলকূপ স্থাপন ও সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, নতুন বিদ্যালয় নির্মাণ, প্রত্যেক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার স্থাপন, দুই বছর মেয়াদী প্রাক-প্রাথমিক স্তর চালু করা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনুপাত আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণ, সহকারী শিক্ষক নিয়োগ, প্রাক-প্রাথমিকের জন্য শিক্ষক পদ সৃজন করা ও শিক্ষক নিয়োগ, সংগীত ও শারিরীক শিক্ষক নিয়োগ, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ, মাল্টিমিডিয়া ও ল্যাপটপ বিতরণ, জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ উদযাপন, পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ, স্কুল ফিডিং ও উপবৃত্তি প্রদানসহ নানামুখি কার্যক্রম বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। যার প্রায় শতভাগ বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগের এক পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সারাদেশে সবধরণের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট সংখ্যা ছিলো ৮২ হাজার ২১৮টি। গত ১৫ বছরে এই সংখ্যা বেড়েছে ব্যাপকহারে। ২০২২ সালে এসে সারাদেশে সবধরণের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা হচ্ছে এক লাখ ১৪ হাজার ৫৩৯টি। অর্থাৎ বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে ৩২ হাজার ৩২১টি। ১৯৭৩ সালে দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিলো ৩৭ হাজার ৬৭২টি। তারপর আর কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ হয়নি। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ হাজার ১৯২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন।২০০৬ সালে সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল এক কোটি ৬০ লাখ এক হাজার ৬০৫ জন। ২০২২ সালে এসে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ কোটি ৫৪ লাখ ৬ হাজার ৯১ জনে। অর্থাৎ গত ১৬ বছরে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১২ গুণ। ২০০৬ সালে যেখানে ছেলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৭৯ লাখ ১৯ হাজার ৮৩৭ জন এবং মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৮০ লাখ ৮১ হাজার ৭৬৮ জন, সেখানে এই সংখ্যা বেড়ে উন্নীত হয়েছে যথাক্রমে ছেলে এক কোটি ২৪ হাজার ৯৫১ জন এবং মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক কোটি ৫২ লাখ এক হাজার ১৪০ জন।

 একইভাবে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে। ২০০৬ সালে ছিল মাত্র ৩৩ হাজার ২৯৬ জন। বর্তমানে এ সংখ্যা ১৫ লাখ ১৭১ জন। শিক্ষার্থীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শিক্ষকের সংখ্যা। ২০০৬ সালে যেখানে শিক্ষকের সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৬৫ হাজার ৯২৫ জন, ২০২২ সালে শিক্ষকের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে হয়েছে ৬ লাখ ২৬ হাজার ৪২ জন।

শেখ হাসিনার এই ১৫ বছরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নতুন করে সংযোজন হয়েছে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম। এটা আগে ছিল না। বর্তমানে প্রাক-প্রাথমিকে শিক্ষার্থী আছে ৩৩ লাখ ৮৩ হাজার ৭২৬ জন। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য নিয়োগ দেয়া হয় ৩৭ হাজার ৮৮১ জন শিক্ষক। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর আনুপাতিক হারে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আগে প্রতি ৫২ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক ছিলেন একজন। বর্তমানে ৩৩ জন জন্য শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক।

শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার বিষয়টি সরকারকে নানাভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল। ২০০৬ সালে দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর হার ছিল ৫০ দশমিক ৫ শতাংশ। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বর্তমান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। ফলে বর্তমানে ঝরেপড়ার হার নেমে এসেছে ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশে।   প্রাথমিক শিক্ষায় বর্তমান সরকারের অন্যতম সাফল্য হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীর হাতে শতভাগ নতুন বই তুলে দেওয়া। যা বিগত সময়ে কোন সরকারের আমলেই হয়নি। ২০০৬ সালে যেখানে মোট বিতরণকৃত বইয়ের মধ্যে ৫০ শতাংশ সাদাকালো বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হত, সেখানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রতিবছর বিতরণকৃত বইয়ের শতভাগ রঙিন এবং বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয়।

এছাড়াও বর্তমান সরকার প্রত্যেক বছর বিদ্যালয়গুলোতে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আয়োজন করাসহ আরও অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সরকারের এসব পদক্ষেপ শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখি হতে উৎসাহিত করেছে।