প্রভাষ আমিন

স্বপ্ন  নিয়ে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামের একটি উক্তি আমার খুবই প্রিয়, ‘স্বপ্ন  সেটা নয়, যেটা আপনি ঘুমিয়ে দেখেন। স্বপ্ন হলো সেটা, যেটা আপনাকে ঘুমাতে দেয় না।‘ বলা হয়, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। স্বপ্নই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু স্বপ্ন দেখতে হবে আপনার যোগ্যতা, দক্ষতা, অধ্যবসায় আর পরিশ্রমের সমান্তরালে। স্বপ্ন দেখলেই হবে না। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। আপনি স্বপ্ন দেখলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু স্বপ্ন দেখার পর বাসায় বসে থাকলেন। তাহলে আপনার সেই স্বপ্ন কখনো পূরণ হবে না। স্বপ্ন পূরণের জন্য সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, স্বপ্ন দেখতে সাহস লাগে, দূরদর্শিতা লাগে। স্বপ্ন নিয়ে এত কথা বলার কারণটা বলি এবার। ২০০৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে এক নির্বাচনী জনসভায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল নির্মাণের অঙ্গীকার করেছিলেন। তখন বিএনপি নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেছিলেন, ‘নদীর নিচ দিয়ে টানেল তৈরি স্বপ্নে ঘি খাওয়ার মতই।‘ কিন্তু বাস্তবতা হলো স্বপ্নে খাওয়া সেই ঘি এখন বাস্তব। কর্ণফুলী নদীর নিচের টানেল এখন তৈরি। উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা এই টানেল দিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নের এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।

আব্দুল্লাহ আল নোমান যেমনটি বলেছিলেন, তা কিন্তু খুব ভুল বলেননি। অসম্ভব কোনো স্বপ্ন হলে আমরা এমনই বলি, স্বপ্নে পোলাও খেলে তাতে ঘি একটি বেশি দিতেও সমস্যা নেই। সমস্যা হলো, আব্দুল্লাহ আল নোমান বা তার দলের স্বপ্ন দেখার সেই সাহস ছিল না। তাই যে কোনো স্বপ্নই তাদের কাছে ঘি খাওয়ার মত মনে হয়। ্রাগেই যেমনটি বলেছি, স্বপ্ন দেখতে সাহস লাগে, দূরদর্শিতা লাগে। স্বপ্ন বাস্তবায়নে লেগে থাকতে হয়, পরিশ্রম করতে হয়। শেখ হাসিনা স্বপ্নে পোলাও খেয়েছেন এবং তাতে ঘি একটু বেশিই দিয়েছেন। ১/১১ সরকার অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করেছিল শেখ হাসিনাকে। কারাগারে বসে শেখ হাসিনা স্বপ্ন দেখেছিলেন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের। তৈরি করেছিলেন উন্নত বাংলাদেশের রূপরেখা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর সেই উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এপিজে আব্দুল কালামের কথার মত শেখ হাসিনা ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেননি। বরং উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন তাঁকে ঘুমাতে দেয় না। তিনি বিরামহীন কাজ করে বাংলাদেশকে তুলে এনেছেন অন্য এক উচ্চতায়। আগামী ২৮ অক্টোবর আব্দুল্লাহ আল নোমানের ভাষায় ‘স্বপ্নের ঘি’ কর্ণফুলী টানেল খুলে দেয়া হবে। তার মানে কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে চলবে। অনেকের কাছে যেটা স্বপ্ন, সেটা এখন বাস্তব। শুধু কর্ণফুলী টানেল নয়, এসন আরো অনেক অকল্পনীয় ঘটনা ঘটিয়েছেন শেখ হাসিনা। যেটা আসলে আমরা ভাবতেও পারিনি। ১৫ বছর আগে কেউ যদি বলতেন, ঢাকায় মেট্রোরেল চলবে, কেউ বিশ্বাস করতো না। এখন আমরা উন্নত বিশ্বের মত আধুনিক মেট্রোরেলে চড়ে অল্প সময়ে গন্তব্যে পৌছে যাচ্ছি। বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর সবাই ভেবেছিলেন পদ্মা নদীর ওপর সেতু বুঝি আর হচ্ছে না। একজনের ভাবনা ছিল ভিন্ন। তিনি শেখ হাসিনা। আগেই যেমন বলেছি, স্বপ্ন দেখতে সাহস লাগে। সেই সাহস শেখ হাসিনারই আছে। বিশ্বব্যাংককে বুড় আঙ্গুল দেখিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বানিয়ে শেখ হাসিনা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশ আর সেই বাংলাদেশ নেই। পদ্মা সেতু নিছক সেতু, আমাদের সামর্থ্যের প্রতীক। দোতলা সেতুতে এখন ট্রেনও চলছে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে অনেক নতুনের সাথে পরিচয় করে দিয়েছেন। যার সর্বশেষটি হতে যাচ্ছে কর্ণফুলী টানেল। আগে বাংলাদেশে সাবমেরিন ছিল না, স্যাটেলোইট ছিল না, পারমাণবিক বিদ্যুৎ ছিল না, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ছিল না, মেট্রোরেল ছিল না। শেখ হাসিনা আমাদের উন্নয়নের নতুন নতুন অধ্যায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন।

নিন্দুকেরা বলেন, শেখ হাসিনা তো নিজের টাকায় টানেল বানাননি, মেট্রোরেল বানাননি, পদ্মা সেতু বানাননি। সবই তো জনগণের টাকা। খুবই সত্যি কথা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনার আগে কেউ এগুলো বানাননি কেন। তখনও জনগণের অর্থ ছিল। আগেই যেমনটি বলেছি, স্বপ্ন দেখতে সাহস লাগে। সেই সাহস শেখ হাসিনা ছাড়া আর কার আছে? অনেকে এমনও বলেন, আমাদের টানেল লাগবে কেন, সাবমেরিন লাগবে কেন, স্যাটেলাইট লাগবে কেন? খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। আসলে প্রসঙ্গটা হলো সক্ষমতার, সামর্থ্যের, মনোভাবের। এটা ঠিক সাবমেরিন না হলেও চলতো, স্যাটলাইট না হলেও চলতো, টানেল না হলেও কিছুই আটকে থাকবে না। কিন্তু এই প্রকল্পগুলো আসলে মর্যাদা দেয়, সক্ষসতা বাড়ায়। আপনি যখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাবেন, মর্যাদার সাথে সাথে আপনার দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়বে। ব্যাংক কিন্তু সবাইকে ঋণ দেয় না। যার সক্ষমতা আছে, তাকেই দেয়। দেশের ক্ষেত্রেও বিষয়টি সত্যি। আপনিার একজন অকর্মণ্য আত্মীয়কে আপনি যতটা গুরুত্ব দেবেন; একজন সফল ও মর্যাদাবান অনাত্মীয়কেও নিশ্চয়ই তারচেয়ে বেশি দেবেন। টানেল, স্যাটেলাইট, সাবমেরিনকে কারো কারো কাছে আপাতদৃষ্টিতে অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। কিন্তু এগুলো আমাদের সক্ষমতার ধাপ, মর্যাদার একেকটি চাবি। একসময় আমাদের ‘দাতাসংস্থা’ ছিল, এখন আছে আমাদের ‘উন্নয়ন সহযোগী’ আছে। এটা হলো মাইন্ডসেট। এটা হলো বদলে যাওয়া বাংলাদেশের ছবি।

তবে কর্ণফুলী টানেল শুধু মর্যাদা জন্য বানানো নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম। কর্ণফুলী টানেল বদলে দিতে পারে গোটা চট্টগ্রামকেই, যাতে গতি আসবে অর্থনীতিতে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত এই টানেলটি চট্টগ্রামকে ‘দুই শহর নিয়ে এক মহানগর’এ পরিণত করবে। মাল্টি লেন টানেলটি চট্টগ্রাম বন্দরকে সরাসরি আনোয়ারা উপজেলার সঙ্গে সংযুক্ত করবে, এর মাধ্যমে কক্সবাজার সরাসরি চট্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হবে। টানেলটি প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়েকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করবে এবং দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে। টানেলে ৩৫ ফুট চওড়া ও ১৬ ফুট উঁচু এবং ১১ মিটার ব্যবধানে দুটি টিউব স্ভপান করা হয়েছে, যাতে ভারী যানবাহনগুলি সহজেই টানেলের মধ্য দিয়ে চলাচল করতে পারে। এই টানেলে যানবাহন ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে চলাচল করতে পারবে। প্রথম বছরে এই টানেল দিয়ে ১৭ হাজারের বেশি গাড়ি পারাপার হবে বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে। সমীক্ষা অনুসারে, ২০৩০ সালে বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে ৩৫ হাজারের বেশি গাড়ি পারাপার হবে। একই সঙ্গে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর এবং মিরসরাই ইকোনোমিক জোনের যোগাযোগ স্থাপনে সেতুবন্ধন হবে চট্টগ্রাম বন্দর। বঙ্গবন্ধু টানেল চট্টগ্রামের অর্থনীতিতে দারুণ চাঞ্চল্য আনতে পারে। টানেল ঘিরে ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের। সব মিলিয়ে কর্ণফুলী শুধু রূপে নয়, গুনেও ভোলাবে। আর চট্টগ্রামের অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য এলে তা ছড়িয়ে পড়বে গোটা দেশে।

শুরুতে যেমন বলেছি, স্বপ্ন দেখতে সাহস লাগে। সেই সাহস আছে শেখ হাসিনার। সেই সাহসের ভর করেই টানেলের পথে অন্যরকম এক বাংলাদেশের পথে শুরু হবে নবযাত্রা।