প্রফেসর . মো. আনোয়ার হোসেন

পদ্মা সেতুর স্বপ্ন জয়ের পর আরেকটি স্বপ্ন জয় করে মেট্রোর যুগে প্রবেশ করেছে দেশ। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল ও গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের ‘বিস্ময়’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো উন্নয়নসহ আর্থ-সামাজিক সব খাতে বাংলাদেশ অর্জন করেছে বিস্ময়কর অগ্রগতি। আর্থ-সামাজিক সব সূচকে বাংলাদেশ অনেকক্ষেত্রে তার দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদের থেকে এগিয়ে। যে বাংলাদেশের পরিচিতি ছিল বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ আর হাড্ডি-কঙ্কালসার মানুষের দেশ হিসেবে, সেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ।

স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশকে পুর্নগঠন করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে সমৃদ্ধির পথে শুভযাত্রা শুরু করে তখনই বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সব সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। জাতির পিতার হত্যার মাধ্যমে স্তব্ধ হয়ে যায় উন্নয়ন ও অগ্রগতির চাকা। একই সঙ্গে নস্যাৎ হয়ে যায় স্বাধীনতা সংগ্রামের অর্জনগুলো।

একের পর এক সামরিক ক্যু, হত্যা, ষড়যন্ত্র, সম্পদের লুটপাট বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়। সৌভাগ্যক্রমে বিদেশে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও তার পরম স্নেহাস্পদ ছোটবোন শেখ রেহানা, যার হাত ধরে আজ বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজকের বাংলাদেশের ঈর্ষান্বিত সাফল্যে আমরা গর্বিত।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ২০১৫ সালে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০১৮ সালে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে-বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২০,০০০ মেগাওয়াটে উন্নীতকরণ; জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ৭.৮৬ শতাংশে উন্নীতকরণ; ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা নিয়ে বিরোধের নিষ্পত্তি; প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন; মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ; কৃষকদের জন্য কৃষিকার্ড এবং ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলা; বিনা জামানতে বর্গাচাষীদের ঋণ প্রদান; চিকিৎসা সেবার জন্য সারাদেশে প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন; দারিদ্র্যের হার ২০০৫-০৬ সালের ৪১.৫ থেকে ২০১৭-২০১৮ বছরে ২১ শতাংশে হ্রাস; ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময় ইত্যাদি।

আর্থ-সামাজিক সক্ষমতা অর্জনের ক্ষেত্রে আজকের বাংলাদেশ এখন এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। আজকের বাংলাদেশ আর্থিক দিক থেকে যেমন শক্তিশালী, তেমনি মানসিকতার দিক থেকে অনেক বলীয়ান। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এখন পারমাণবিক ক্লাবের সদস্য। একইভাবে মহাকাশে বাংলাদেশের পতাকা-সংবলিত নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে আমরা হয়েছি এলিট স্যাটেলাইট ক্লাবের সদস্য।

আজকের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল একটি অতি প্রয়োজনীয় এবং আভিজাত্যের প্রতীক। বিশ্ব ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে জিডিপি’র নিরিখে বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে বিশ্বের মধ্যে ৪২তম এবং ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে ৩২তম। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (Sustainable Development Goals) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে SDG’র ১৬৯টি লক্ষ্যের আলোকে কৌশলগত উদ্দেশ্য, কর্মসম্পাদন সূচক এবং লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

২০০৮-০৯ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প এর মাধ্যমে ১৩৮৩.৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮৫০০ ব্যারাক নির্মাণ করে ৪৭,১০০টি পরিবার পুনর্বাসন করা হয়েছে। ৩৪,০০০ পুনর্বাসিত পরিবারকে পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করে তাদের মধ্যে ৪৯.৯০ কোটি ঋণ প্রদান করা হয়েছে।

কৃষিক্ষেত্রে সময়োপযোগী পদক্ষেপের ফলে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে চতুর্থ, আম উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় এবং খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান দশম যার ফলে দেশ আজ দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

লবণাক্ততা, খরা, জলমগ্নতা সহনশীল ও জিংকসমৃদ্ধ ধানসহ এই পর্যন্ত ধানের ১০৮টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে বর্তমান সরকারের আর্থিক সহযোগিতায়। ২০০৯ থেকে বিভিন্ন ফসলের ৫৮৪টি উচ্চফলনশীল নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা।

২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে অদ্যাবধি বিআরআরআই কর্তৃক ধানের ৩৫টি জাত, বিএআরআই কর্তৃক বিভিন্ন ফসলের ১৭০টি জাত, বিজেআরআই কর্তৃক পাটের ৯টি জাত, বিএসআরআই কর্তৃক ইক্ষুর ৮টি জাত ও সুগার বীটের ৪টি জাত, সিডিবি কর্তৃক তুলার ৭টি জাত এবং বিআইএনএ কর্তৃক বিভিন্ন ফসলের ৫৫টি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।

জিএমও প্রযুক্তি ব্যবহার বিটি বেগুনের ৪টি জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সামাজিক নিরাপত্তা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অবদান রেখে চলেছে।

২০০৮-০৯ অর্থবছরে বয়স্কভাতা ছিল জনপ্রতি মাসিক ২৫০ টাকা হারে এবং ২০ লক্ষ বয়স্ক ব্যক্তির জন্য বাজেট বরাদ্দ ছিল ছয়শ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৪০ লক্ষ বয়স্ক ব্যক্তির জন্য জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকায় উন্নীত করা হয় তার জন্য ব্যয় হয় ২৪০০ কোটি টাকা এবং এই বয়স্কভাতার হার ও সংখ্যা আরও বৃদ্ধির পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে।

২০০৮-০৯ অর্থবছরে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা খাতে জনপ্রতি মাসিক ২৫০ টাকা হারে ৯ লাখ বিধবা, স্বামী নিগৃহীতা নারীর জন্য বাজেট বরাদ্দ ছিল ২৭০ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা হারে ১৪ লাখ মানুষের জন্য ব্যয় হয় ৮৪০ কোটি টাকা। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা খাতে জনপ্রতি মাসিক ২৫০ টাকা হারে ২ লাখ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য বাজেট বরাদ্দ ছিল ৬০ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মাথাপিছু মাসিক ৭০০ টাকা হারে ১০ লাখ মানুষের জন্য বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে ৮৪০ কোটি টাকা।

বর্তমান সরকারের দক্ষ নেতৃত্বে বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ১১ বিলিয়ন ডলার থেকে ৫২ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ, রপ্তানি ও বিদেশে কর্মসংস্থানের ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০০৫ সালে ছিল ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, এখন তা ৪০ বিলিয়ন হয়েছে।

আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে সারাদেশের গৃহহীন ও আশ্রয়হীন পরিবারের জন্য নির্মিত ঘরের মতো বেদে সম্প্রদায়ের জন্য ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০০৬ সালে উপবৃত্তি প্রাপ্ত বেদে জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ০ (শূন্য) জন। বর্তমান সরকারের সময়ে তা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯৯৮। এই প্রকল্পের আওতায় এই পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ ৪০ হাজার পরিবারের প্রায় ৫০ লাখ মানুষকে বিনামূল্যে জমি ও ঘর বিতরণ করা হয়।

পরাধীনতার ২৩ বছরের অত্যাচার, নির্যাতন এবং যৌবনের ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করে বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন তা র্পূণতা এনে দেওয়ার সুযোগ স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি দেয়নি। হত্যার নিশানা থেকে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাবার অসমাপ্ত কাজ পূর্ণতা দেওয়ার জন্য দায়িত্ব নেন। কিন্তু তারও এপথ মসৃণ নয়। ১৯ বার হত্যা চেষ্টার পরও শেখ হাসিনা বেঁচে আছেন এবং সরকার গঠন করে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলেই দ্রুত সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই এগিয়ে যাওয়া আবার থামিয়ে দিতে চায় জাতির পতাকা খামচে ধরে থাকা সেই সে পুরোনো শকুন। এবারের নির্বাচনী ডামাডোলে সেই পরাজিত শক্তি আবার একত্রিত হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হলে যে মূল্য দিতে হবে তা কি আর পূরণ হবে?