অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান

আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস (১৭ অক্টোবর ২০২৩)-এর প্রতিপাদ্য ছিল ‘শোভন কাজ ও সামাজিক সুরক্ষা, সকলের জন্য সমান মর্যাদা’। বিশ্ব পরিসরে অর্থনীতির সংযোগ বাড়ার কারণে বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের মতো অনেক দেশেই মানুষের কাজের সুযোগ বেড়েছে।

তাদের আয়-রোজগার অনেকটাই বেড়েছে। তাই সমাজের নিচের স্তরের মানুষের দারিদ্র্যের হার অনেকটাই কমেছে। ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে দারিদ্র্য বিমোচনে অভাবনীয় সাফল্যের কারণে আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবসটি এমনিতেই বাংলাদেশের জন্য আলাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

তবে আমাদের সার্বিক আর্থসামাজিক বাস্তবতার বিচারে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়টি বাড়তি তাৎপর্য বহন করে। কেননা ইতিমধ্যেই আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি, অল্প সময়ের মধ্যেই স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতিও পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের দারিদ্র্য বিমোচন সম্পর্কিত ভাবনা, দর্শন ও অনুশীলনে ব্যাপকভিত্তিক পরিবর্তন কাম্য।

তাই শোভন কাজ, সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা, আর মর্যাদাপূর্ণ জীবনের বিষয়গুলো এখন আর আমাদের জন্য নিছক স্লোগান নয়। বরং বাস্তব নীতি অভীষ্ট। নিঃসন্দেহে দেশের অর্থনীতিতে প্রচুর উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। তারা আবার অনেককেই কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছেন। তাদের জন্য যদি আরও বেশি নির্ঝঞ্ঝাট কাজের সুযোগ দেওয়া যায়, সহজে অর্থায়নের সুযোগ দেওয়া যায়, তাদের তৈরি পণ্য ও সেবার বাজার সুবিধা দেওয়া যায়—তাহলে দারিদ্র্যের হার আরও দ্রুত কমানো সম্ভব।

এখন থেকে প্রায় ১৫ বছর আগে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার জাতীয় লক্ষ্য নিয়ে যখন কাজ শুরু হয়েছিল তখন এই দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৩২ শতাংশ। আর সর্বশেষ হিসেবে তা নেমে এসেছে ১৯ শতাংশের নিচে (একই সময়ের ব্যবধানে অতিদারিদ্র্যের হার প্রায় ১৮ শতাংশ থেকে কমে ৬ শতাংশের নিচে নেমেছে)।

ধারাবাহিকভাবে জাতীয় বাজেটে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ এবং সার্বিক অর্থনৈতিক বিকাশবান্ধব বিনিয়োগের সুবাদেই এই অর্জন এসেছে। এক্ষেত্রে খুবই কার্যকর সম্পূরক ভূমিকা পালন করেছে দেশের বেসরকারি সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা।

ব্যক্তিখাতও ক্রমেই নগরকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে এসে প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক সুযোগ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। ফলে কৃষির যেমন ব্যাপক বিকাশ ও আধুনিকায়ন হয়েছে তেমনি গ্রামাঞ্চলেও এখন অকৃষি খাত থেকেই মানুষের আয়ের বড় অংশটি আসছে (দুই-তৃতীয়াংশের বেশি)।

গ্রাম ও শহরের মানুষের অর্থনৈতিক সুরক্ষায় জাতীয় নীতিগুলোও তাই নতুন যুগে প্রবেশ করছে। সচরাচর যে সব টার্গেটেড সামাজিক সুরক্ষা আমরা দেখে এসেছি সেইগুলোয় ডিজিটাইজেশনের সুবাদে ইতিবাচক পরিবর্তন তো আসছেই। পাশাপাশি পেনশন স্কিমের মতো সর্বজনীন সুরক্ষা কর্মসূচি নিয়েও কাজ শুরু হতে দেখছি।

এখন পর্যন্ত দারিদ্র্য বিমোচনের যে অনুশীলনগুলো আমরা সফল হতে দেখেছি সেইগুলো বলা যায় ‘গ্র্যাজুয়েশন ফোকাসড’, অর্থাৎ প্রান্তিক মানুষকে দারিদ্র্য রেখার নিচ থেকে ওপরে উঠিয়ে আনাই মুখ্য বিষয়। কিন্তু এখন দারিদ্র্য রেখার নিচ থেকে মানুষকে উঠিয়ে আনার পাশাপাশি যারা ওপরে আছেন তারা কোনো অর্থনৈতিক ধাক্কার কারণে যেন নতুন করে দারিদ্র্যে পতিত না হন তা নিশ্চিত করার মতো কর্মসূচিগুলো নিয়েও ভাবতে হবে।

স্বাস্থ্যসেবার অভিগম্যতা এক্ষেত্রে একটি উপযুক্ত উদাহরণ হতে পারে। জানা গেছে, সারা বিশ্বে প্রতি বছর ২.৫ কোটি পরিবার স্বাস্থ্য ব্যয়ের কারণে নতুন করে দারিদ্র্যে পতিত হয়। বাংলাদেশে যেহেতু মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই নাগরিকদের বহন করতে হয়, তাই বলা যায় এই কারণে আমাদের দেশেও বিপুল সংখ্যক মানুষ নতুন করে দারিদ্র্য রেখার নিচে চলে যান।

এটা ঠেকানো না গেলে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে গেল দশকে যে গতি অর্জন করা গেছে সামনের দশকে তা বহাল রাখা সম্ভব হবে না। শুধু স্বাস্থ্য ব্যয়ই নয়, বড় ধরনের যেকোনো অর্থনৈতিক ধাক্কা এলেই দারিদ্র্য রেখার সামান্য ওপরে থাকা মানুষদের অনেকেই নতুন করে দারিদ্র্যে পতিত হন। করোনাকালেই আমরা এমন ঘটতে দেখেছি।

মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, শিক্ষার হার, গড় আয়ু, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাসের মতো সবগুলো মানব উন্নয়ন সূচকেই আমাদের অনুসরণীয় সাফল্য যে আছে তা মানতেই হবে। আগামী দিনে এসব সূচকে আরও ভালো করার সম্ভাবনা যে আমরা তৈরি করেছি তাও অনস্বীকার্য। তবুও এখন আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। বরং এই যাবৎকালের অর্জন আর আগামীর সম্ভাবনাগুলোর কথা ভেবে আত্মপ্রত্যয়ী হতে হবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য।

কেননা এখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং আমাদের নিজস্ব ম্যাক্রো-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাগত সংকটের কারণে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। মনে রাখতে হবে ডলার সংকট, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, বিনিয়োগ ও প্রবাসী আয়ের গতি কমে আসার মতো সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সবচেয়ে বেশি চাপের মুখে পড়ছেন সামাজিক পিরামিডের পাটাতনে থাকা দরিদ্র ও প্রান্তিক নাগরিকেরাই।

তাই দারিদ্র্য বিমোচনের নীতি-আলোচনায় সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতির কারণে যে হারে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে সেই দিকটাও দারিদ্র্য বিমোচনের আলাপে নতুন করে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

আগামী বছর দশেকের মধ্যে বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে দারিদ্র্য হারকে একটি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নামিয়ে আনতে জোর দিতে হবে কৃষি ও এসএমই খাতের ওপর। এই যাবৎকালের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে কৃষি খাতের বিকাশের সঙ্গে আমাদের দারিদ্র্য কমে আসার একটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে।

২০১৭ সালে ব্র্যাকের জরিপভিত্তিক গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে এই দেশে কৃষি আয় ১ শতাংশ বাড়লে দারিদ্র্য কমে ০.৩৯ শতাংশ করে (অ-কৃষি আয় একই মাত্রায় বাড়লে দারিদ্র্য কমে ০.১১ শতাংশ)। কাজেই দারিদ্র্য বিমোচনের ম্যাক্রো-পরিকল্পনায় কৃষিকেই রাখতে হবে অগ্রাধিকারের জায়গায়।

আশার কথা এই যে, আমাদের নীতি-নির্ধারকরা সেই পথেই হাঁটছেন। তাই তো বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যেও টানা ষষ্ঠ বছরের মতো রেকর্ড বোরো ফসল উৎপাদনের খবর পাওয়া গেছে সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন থেকে (২.০৭ কোটি টন)। তবে কৃষি খাতে এখনো শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশ বিনিয়োজিত থাকলেও এই খাতের প্রত্যাশিত আধুনিকায়নের সাথে সাথে শ্রমের চাহিদা আরও কমবে।

তাই দরিদ্র মানুষের আয়ের উৎস নিশ্চিত করতে এমএসএমইগুলোর দিকেও নজর দেওয়া চাই। ইতিমধ্যেই দেশের শ্রমশক্তির ৩০ ভাগ এমএসএমই খাতে যুক্ত আছে, আর দেশের জিডিপিরও এক-চতুর্থাংশের মতো আসছে এই খাত থেকেই। তাই দরিদ্র মানুষকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে এবং তাদের জন্য টেকসই কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে এমএসএমই খাতের আরও কার্যকর বিকাশ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। আর তা করা গেলে নারীর পক্ষে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ বাড়বে। এর প্রভাবে দারিদ্র্যও কমবে।

সর্বোপরি আগামী দিনের দারিদ্র্য বিমোচন সংক্রান্ত ভাবনায় সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার দিকে। বৈশ্বিক উষ্ণতা আর ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে এই দেশের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ চলে যাবে সমুদ্রের নিচে, আর বাস্তুচ্যুত হবেন সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্যকর অভিযোজন নিশ্চিত করা না গেলে দারিদ্র্য বিমোচনে আমাদের অর্জনগুলো ধরে রাখা মোটেও সম্ভব হবে না।

মোট কথা, দারিদ্র্য বিমোচনের যে নিরন্তর সংগ্রাম, আমরা তার একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। এই নতুন যুগে সরকার ও সরকারের বাইরে থাকা অংশীজনদের ভূমিকাগুলো যেমন নতুন করে চিহ্নিত করতে হবে। তেমনি দারিদ্র্য বিমোচনে নেওয়া কর্মসূচিগুলোর অভীষ্ট এবং বাস্তবায়নের কৌশলেও পরিবর্তন আনতে হবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।

এমনকি দারিদ্র্যের সংজ্ঞা নিয়েও নতুন করে ভাবতে হবে। ভেবে দেখুন বছর বিশেক আগে একটি মোবাইল ফোন ছিল সচ্ছলতার প্রতীক। আর ডিজিটাল আর্থিক সেবার প্রসারের কারণে আজ একটি মোবাইল ফোন যার নেই তাকে অতিদরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত করলে ভুল হবে না। নতুন সময়ে তাই দারিদ্র্য বিমোচনের আলোচনাও নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত করা চাই।

এই আলাপে মনের পরিবর্তনের দিকগুলোর ওপর জোর দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথের মতে দারিদ্র্যের ভয়টা আসলে ভূতের ভয়। সামাজিক ঐক্য নিশ্চিত করা গেলে একলা মানুষের মনের দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব হবে। আমরা দেখেছি দুঃখের দিনে এক হয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতা ও দুর্যোগ মোকাবিলা করে মনের দারিদ্র্য দূর করার সুযোগে এসেছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন করে দারিদ্র্য নিরসনের নতুন পথের সন্ধান নিশ্চয় করা সম্ভব।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।