অমিত দত্ত

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশ গত কয়েক দশক ধরে একটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এই রূপান্তরের পেছনে অন্যতম চালিকাশক্তি হল বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশি প্রবাসীদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে রেমিট্যান্স প্রবাহ।

প্রবাসী শ্রমিকদের অর্জিত অর্থ এবং তা নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ফলে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে । বিদেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মরত রয়েছে।

তারা যে অর্থ দেশে পাঠায় তা দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। রেমিট্যান্স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের মাথাপিছু আয় এবং মোট জিডিপিও বৃদ্ধি পায়। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রবাসী আয়ের অর্থ দেশের দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা, শিশুর পুষ্টি ও শিক্ষার ক্ষেত্রেও অবদান রাখছে।

 বিভিন্নি দেশে বসবাসরত রেমিট্যান্স যোদ্ধারা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ হাজার ৮২০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন, যা বিগত বছরগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। করোনা মহামারির কারণে রেমিট্যান্স কমে যাবে বলে ধারণা করা হলেও তা হয়নি। সরকারের নানামুখী তৎপরতার কারণে প্রবাসীদের একমাত্র ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হয়। যার ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরে সব মিলিয়ে প্রবাসী আয় এসেছিল প্রায় ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি।

এই তহবিলগুলি প্রায়শই স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, আবাসন এবং ছোট ব্যবসায় বিনিয়োগের মতো প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া, রেমিট্যান্স পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বিভিন্ন সময় প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্দাদেরকে, হুন্ডির পরিবর্তে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠাতে এবং দেশে বিনিয়োগ করতে আহ্বান করেছেন। প্রবাসী আয় বৃদ্ধিপেলে ব্যবসার বৃদ্ধি ঘটবে , কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক প্রসার ঘটবে যা বাংলাদেশের সামগ্রীক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করবে। এছাড়াও রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকেও শক্তিশালী করবে যা  স্থানীয় মুদ্রায় স্থিতিশীলতা প্রদান এবং বাণিজ্য ঘাটতি মোকবেলায় সহায়তা করবে।

রেমিট্যান্স নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য একটি আশীর্বাদ। তবে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জও রয়েছে যা মোকাবেলা করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে এবং রেমিট্যান্স যেন বৈধ পথে আসে তার ব্যবস্থা করতে হবে।  আরেকটি চ্যালেঞ্জ রেমিট্যান্স তহবিলের কার্যকর ব্যবহার। এই তহবিলগুলি অর্থনীতির উত্পাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা হয় তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর পাশাপাশি সঞ্চয়কে উৎসাহিত করা, আর্থিক সাক্ষরতার প্রচার করা এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং ছোট ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া রেমিট্যান্সের ইতিবাচক প্রভাবকে সর্বাধিক করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।

টেকসই উন্নয়নের জন্য রেমিট্যান্সের পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশ বেশ কিছু কৌশলগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। প্রথমত, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ অত্যাবশ্যক। কর্মশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে, বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে পারে যে তার প্রবাসী শ্রমিকরা বিদেশে উচ্চ বেতনের চাকরি নিশ্চিত করতে পারে, যার ফলে রেমিটেন্স বৃদ্ধি পায়। তদুপরি, দক্ষ শ্রমিকরা তাদের ফিরে আসার পরে দেশের অর্থনীতিতে অর্থপূর্ণ অবদান রাখার সম্ভাবনা বেশি।

দ্বিতীয়ত, উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য একটি সক্ষম পরিবেশ তৈরি করতে হবে যোতে করে রেমিট্যান্সের টাকা দেশীয় বিনয়োগে প্রভাব রােখতে সক্ষম হয়। অনেক রেমিট্যান্স গ্রহণকারী পরিবার তাদের নিজস্ব ব্যবসা শুরু করতে চায়। তাদের আর্থিক সংস্থান, মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম এবং বাজারের সংযোগে অ্যাক্সেস প্রদান করা তাদের সফল উদ্যোগ প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা দিতে পারে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের উদ্যোগ (এসএমই) সমর্থন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে পারে এবং দারিদ্র্য হ্রাস করতে পারে।

তৃতীয়ত, দেশের আর্থিক অবকাঠামো শক্তিশালী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রেমিট্যান্স লেনদেনের জন্য আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহারে উৎসাহিত করা স্বচ্ছতা বাড়াতে পারে, খরচ কমাতে পারে এবং তহবিলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটানোর অন্যতম সহজ উপায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো। আর বৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে প্রবাসীদের জন্য রেমিট্যান্স পাঠানো সহজ করতে হবে। তবে সুবিধাভোগীদের কাছে তা নিরাপদে ও তাৎক্ষণিকভাবে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্লাটফর্মই হতে পারে সবচেয়ে ভালো মাধ্যম। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ, যেমন মোবাইল ব্যাঙ্কিং এবং ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমগুলি, বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যাঙ্কিং পরিষেবাগুলিতে সহজে অ্যাক্সেসের সুবিধা দিতে পারে।

সর্বশেষ, সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচিতে বিনিয়োগ অভিবাসী শ্রমিকদের পরিবারের মুখোমুখি হওয়া আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলিকে প্রশমিত করতে পারে। সাশ্রয়ী মূল্যের স্বাস্থ্যসেবা, মানসম্পন্ন শিক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী রেমিট্যান্স গ্রহণকারী পরিবারের সামগ্রিক যেমন  উন্নত করতে পারবে টিক তেমনি, দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্র ভেঙ্গে এবং আরও ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন  করতে পারে।

উদ্ভাবনী বাংলাদেশ বিনির্মাণে জনগণের দোরগোড়ায় সহজে, দ্রুত ও স্বল্প ব্যয়ে সরকারি সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ৪৫০১টি ইউনিয়নে একযোগে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র উদ্বোধন করেন যা বর্তমানে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (UDC) নামে সুপরিচিত।

ইউনিয়ন পর্যায়ে UDC গুলো নাগরিকবৃন্দের জীবনমান পরিবর্তনে ইতিবাচক অবদানের ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে দেশের ৩২৮টি পৌরসভায় পৌর ডিজিটাল সেন্টার (PDC) এবং ১১টি সিটি কর্পোরেশনের ৪৬৫টি ওয়ার্ডে নগর ডিজিটাল সেন্টার (CDC), ২০১৮ সালে বিশেষ জনগোষ্ঠীর চাহিদার আলোকে ৬টি স্পেশালাইজড ডিজিটাল সেন্টার (SDC) (গার্মেন্টস কর্মীদের জন্য গাজীপুরে ৫টি এবং মৎসজীবী শ্রমিকদের জন্য খুলনার রুপসায় ১টি) এবং সৌদি আরবে ১৫টি এক্সপাট্রিয়েট ডিজিটাল সেন্টার (EDC) চালু করা হয়েছে।

বর্তমানে দেশব্যাপী ৮২৯৭ টি ডিজিটাল সেন্টারে কর্মরত ১৬০৮৭ জন উদ্যোক্তা ব্যাংকিং এবং ই-কমার্স সেবাসহ ৩২০ -এর অধিক সরকারি-বেসরকারি সেবা প্রদান করছেন। ডিজিটাল সেন্টার থেকে ২০২০ সাল নাগাদ মোট সেবা প্রদান করা হয়েছে ৬৮.৪ কোটি। সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নাগরিকদের ১.৬৮ বিলিয়ন সমপরিমাণ কর্ম ঘন্টা, ৯.২৫ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ খরচ এবং ০.৫ বিলিয়ন সমপরিমাণ যাতায়াত সাশ্রয় হয়েছে। নাগরিকদের জীবনমান পরিবর্তনে ইতিবাচক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ডিজিটাল সেন্টার ২০১৪ সালে ই-গভর্নমেন্ট ক্যাটাগরিতে জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (ITU)-এর ওয়ার্ল্ড সামিট অন ইনফরমেশন সোসাইটি (WSIS) অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছে।  এই ডিজিটাল সেন্টার গুলোকে যথাযথবাবে কাজে লাগাতে পারলে রেমিট্যান্স আসা যেমনন সহজতর হবে ঠিক তেমনি বাংলাদেশের উন্নতির পথ ও সুগম হয়ে উঠবে।

বাংলাদেশের উন্নয়নে রেমিট্যান্স নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এতদসংশ্লিষ্ট  চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং রেমিট্যান্সের ইতিবাচক প্রভাব সর্বাধিক করার জন্য প্রয়োজন কৌশলগত পরিকল্পনা, উদ্ভাবনী সমাধান এবং শক্তিশালী কাঠামো, এবং অর্থনৈতিক  বৈচিত্র্যতা । বিশ্ব বাজারে শ্রমিকের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রবাসী আয় আরো বৃদ্ধি করা সম্ভব। সরকার প্রবাসী আয়ে প্রণোদনার পরিমাণ আরো বাড়াতে পারে। এটি অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ কমাতে সাহায্য করবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশীয় শ্রমিকের বড় একটি অংশ যেহেতু অদক্ষ, তাদের দক্ষ করে তুলতে হবে যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। তাহলে অভিবাসী শ্রমিকরা শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন পাবেন— রেমিট্যান্স বাড়বে। রেমিট্যান্স বাংলাদেশের জন্য যে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে; সরকার রেমিট্যান্স খাতে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ খাতকে আরো প্রসারিত করতে পারে।

লেখক: প্রভাষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।