অধ্যাপক ড. মো. মোতাহার হোসেন

সবুজে ঘেরা শস্য-শ্যামল প্রাণের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। আবার নদীর দেশ, হাওর-বাওড় বা ভাটির দেশও বাংলাদেশ। ভাটি বাংলার অপরূপ রূপে মাতিয়েছে যেন বাংলার প্রকৃতিকে। দিগন্ত বিস্তৃত হাওর এবং তাদের চৌহদ্দি মিলে আমাদের এই ভাটির বাংলা বা হাওর অঞ্চল।

বাংলাদেশের ভূ-বৈচিত্র্যের এক অনন্য দিক হচ্ছে হাওর। বিশাল ভূ-গাঠনিক অবনমনের সাথে ছোট ছোট নদী-নালা, খাল-বিল, ডোবা আর বিস্তীর্ণ সীমাহীন বিল মিলিয়ে গঠিত হয়েছে এই হাওরাঞ্চল। প্রধানত বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে এই হাওরসমূহের দেখা মেলে।

হাওরের নামগুলোও বেশ আকর্ষণীয়। টাঙুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, শনির হাওর, টগার হাওর, মাটিয়ান হাওর, দেখার হাওর, হালির হাওর, সানুয়াডাকুয়া হাওর, শৈলচকরা হাওর, বড় হাওর, হৈমান হাওর, কড়চা হাওর, ধলা পাকনা হাওর, আঙ্গারখালি হাওর, নখলা হাওর, চন্দ্রসোনার থাল হাওর, ডিঙ্গাপুতা হাওর এরকম আরও কত বিচিত্র নামের হাওর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভাটির এসব জেলায়।

হাওরের অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে পরিবর্তিত হয়ে ফুটে ওঠে ভিন্ন ভিন্ন অবয়বে। বর্ষায় হাওরে পানিরাশির ব্যাপ্তি এত বেশি থাকে যে দেখে মনে হয় সমুদ্র। এই সময়ে হাওরের হৃদয়কাড়া সৌন্দর্য আর দিগন্ত জোড়া অথৈ জলরাশি যে কারোর মন উদাস করে দেয়।

উদ্দাম ঢেউয়ের অবিরাম মাতামাতি আর মন মাতাল করা উদাসী হাওয়া যেন ভুলবার নয়। হাওরে নৌকা ভ্রমণের সুখস্মৃতি যিনি জীবনে একবার পেয়েছেন তিনি বারবার ফিরে যাবেন হাওরের টানে। স্মৃতি আহরণের এই তৃষ্ণা জাগরূক থাকে আমৃত্যু। বাংলার আদি ও আসল রূপ অপরূপ হয়ে ফোটে হাওরেই।

হাওর পাড়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবনও হাওর দ্বারা প্রভাবিত। এই অঞ্চলের মানুষের চিন্তা-চেতনা, মেধা-মনন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, অর্থনৈতিক প্রাণচাঞ্চল্য, কৃষি সবকিছু হাওরকেন্দ্রিক। তাই এসব ক্ষেত্রে হাওর এলাকার সঙ্গে দেশের অন্যান্য এলাকার বৈসাদৃশ্য চোখে পড়ার মতো।

বাংলাদেশের হাওর এলাকার গঠন প্রভাব

বাংলাদেশের বিশাল অংশ হাওর এলাকা হিসেবে পরিচিত। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল তথা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাক্ষণবাড়িয়া অর্থাৎ এই সাত জেলার প্রায় ৮ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে হাওর অঞ্চল গঠিত, যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় এক-পঞ্চামাংশ।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দেশে ছোট-বড় ৩৭৩টি হাওর রয়েছে। হাওর এলাকায় প্রায় ২০ মিলিয়ন লোক বসবাস করে যা মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ। বাংলাদেশে আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে হাওরের রয়েছে বিশাল প্রভাব। মূলত ধান চাষ, মৎস্য চাষ, হাঁস চাষ, পানি ফলের চাষ, ইত্যাদি এই অঞ্চলের মূল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।

চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ০.৭৩ মিলিয়ন হেক্টর, বছরে ধান উৎপাদন হয় ৫.২৩ মিলিয়ন টন যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাওরে শস্য নিবিড়তা বা ক্রপ ইনটেনসিটি হচ্ছে ১৪৭ শতাংশ। জিডিপিতে হাওরের অবদান ০৩ শতাংশ-এর ২৫ শতাংশ আসে কৃষি থেকে। হাওর এলাকায় ৩৪ শতাংশ পরিবার প্রান্তিক কৃষক, ৫ শতাংশ পরিবার জাতীয় পর্যায়ের অনেক নিচে এবং ৫১ শতাংশ পরিবার ছোট কৃষক (জাতীয় ৪৯.৫ শতাংশ)। তাছাড়া, ২৮ শতাংশ লোক অতি দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতের ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কৃষি ও কৃষিজীবী মানুষের জীবন জীবিকার ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। অতি বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টি, শিলা বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলে আগাম ও নাবি বন্যা কৃষকের জন্য নিত্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিনিয়ত পাহাড়ি ঢলে নদী ভরাট হওয়ায় নদীতে পানি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।

এপ্রিল মাসে বোরো ধান সংগ্রহের সময় হঠাৎ ভারী বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাওর অঞ্চল প্লাবিত হয়ে নিমিষেই ব্যাপক ফসল হানি ঘটে। সদ্য বাড়বাড়ন্ত ফসল হারিয়ে কৃষকের মর্মান্তিক আহাজারি হাওর ছাড়িয়ে দেশের অন্য প্রান্তেও অনুরণিত হয়।

বোরো ধান সংগ্রহের মৌসুমে কৃষকের আতঙ্ক ও উদ্বেগের শেষ থাকে না এই ভেবে যে কখন তার শ্রমেঘামে ফলানো সোনার ধান পাহাড়ি ঢলে বিলীন হয়ে যাবে। প্রকৃতির কাছে কাতর মিনতি আর ক’টা দিনের যাতে ধান কাটার উপযুক্ত হয়। অনেক সময় কৃষকরা ঢল আসার আগেই আধ-পাকা ধান কেটে ঘরে তোলতে চায় কিন্তু কৃষি শ্রমিকের অপ্রাপ্ততা ও অধিক মজুরির কারণে তাও সম্ভব হয় না।

হাওর এলাকার কৃষির উন্নয়ন যাত্রা

হাওর এলাকার প্রান্তিক কৃষকের কথা চিন্তা করে হাওরকেন্দ্রিক উন্নয়ন ভাবনা প্রথম শুরু হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাধ্যমে। হাওর ও জলাভূমি এলাকার জনগণের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে হাওর উন্নয়ন বোর্ড গঠনের নির্দেশ প্রদান করেন। পরবর্তীকালে ১৯৭৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে হাওর উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা হয় কিন্তু হাওর এলাকার সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের যে স্বপ্ন নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাওর উন্নয়ন বোর্ড গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন তা অকার্যকর হয়ে পড়ে।

১৯৮২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বোর্ডটি বিলুপ্ত করা হলে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন স্থবির হয়ে পড়ে। হাওর এলাকার মানুষ তাদের শিক্ষা-দীক্ষা থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে পিছিয়ে পড়ে। জাতির পিতার পর হাওর এলাকার উন্নয়নের সুবাতাস আবার আসতে থাকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে।

১৯৯৮ সালের ৩ অক্টোবর কিশোরগঞ্জ জেলার মিটামইনে এক জনসভায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাওর ও জলাভূমি এলাকার উন্নয়নে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের ১০ জানুয়ারি দুটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড’ এবং বোর্ডের ‘কার্যনির্বাহী কমিটি’ গঠন করা হয়।

এরপর, হাওর ও জলাভূমি এলাকার উন্নয়নে ব্যাপক গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে ২০১৪ সালের ১৭ নভেম্বর হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডকে অধিদপ্তর ঘোষণার নির্দেশ প্রদান করেন। তারই ধারাবাহিকতায় হাওর এলাকার জনজীবন, জীবিকা, পরিবেশ-প্রতিবেশসহ সার্বিক উন্নয়নের জন্য ২০১২ থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত মোট ২০ বছর মেয়াদি একটি হাওর মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। শুকনো ও বর্ষায় হাওরাঞ্চলের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বহুমুখী ও পরিকল্পিত উপায়ে উদ্যোগ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিলে খুলে যাবে এতদঅঞ্চলের অপার সম্ভাবনার দুয়ার।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে হাওরের কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন

হাওর অঞ্চলের কৃষি দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অনেকটা ভিন্নতর। হঠাৎ পাহাড়ি ঢল এবং অতি বৃষ্টিজনিত বন্যা আসার পূর্বে বোরো ধান সংগ্রহ ছিল এই অঞ্চলের কৃষির প্রধানতম সমস্যা। এছাড়া হাওর অঞ্চলে শ্রমিক সংকট নিরসনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাই এহেন পরিস্থিতিতে যদি ফসল রোপণ, কাটা ও তোলার জন্য যন্ত্রের ব্যবহার করা যায় তবে এই সমস্যা বহুলাংশে সমাধান করা সম্ভব হবে।

বিষয়টি আমলে নিয়ে হাওরের কৃষিকে টেকসই করার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে বর্তমান সরকার বেশকিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রচলিত শ্রমিকের মাধ্যমে পরিচালিত ফসল রোপণ, কর্তন, মাড়াই এবং নির্বিঘ্নে ঘরে তোলার মতো কৃষিকাজ প্রতিস্থাপিত করার লক্ষ্যে শক্তিচালিত কৃষি যন্ত্রপাতি কিনতে এখন সরকার সারাদেশে ৫০ শতাংশ এবং হাওর ও উপকূল এলাকায় ৭০ শতাংশ ভর্তুকি দিচ্ছে।

যন্ত্রপাতির দাম একটু বেশি হওয়ার কারণে সরকার ঋণ সুবিধাও সম্প্রসারণ করেছে-যাতে কৃষকরা ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে সহজে তা কিনতে পারে। ফলে ৩ বছরে শুধু ধান কাটতে কম্বাইন হারভেষ্টারের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ২০০০ শতাংশ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে গত বোরো মৌসুমে নেত্রকোনায় ৭১ শতাংশ, ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় ৬০ শতাংশ, হবিগঞ্জে ৫২ শতাংশ, মৌলভীবাজারে ৫০ শতাংশ এবং সুনামগঞ্জে ৪১ শতাংশ জমির ধান কম্বাইন হারভেষ্টার দিয়ে কাটা হয়েছে, যা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। ফলশ্রুতিতে এই অঞ্চলের বোরো ধান উৎপাদনে শ্রমিকের যে সংকট রয়েছে, তা অনেকটা কেটে যাচ্ছে এবং সময়মতো সংগ্রহ সম্ভব হচ্ছে বলে উৎপাদিত ধান নষ্টও হচ্ছে না।

আর যন্ত্রের ব্যবহারে খরচ কম হওয়ায় কৃষকও ধান উৎপাদন করে ভালো দাম পাচ্ছেন। পাশাপাশি কৃষির একেকটি যন্ত্র একেকজন কৃষককে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলেছে। এভাবে সরকারের কৃষি যান্ত্রিকীকরণ কর্মসূচি হাওর অঞ্চলের কৃষির উৎপাদনশীলতা এবং কৃষকের জীবনমান বৃদ্ধিতে অপরিসীম ভূমিকা রাখছে।

পরিশেষে বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে ক্রমেই হাওর কৃষিতে বাড়ছে ঝুঁকি। এইসব ঝুঁকি মোকাবিলা করে কৃষিকে লাভজনক করতে কৃষি কাজের আধুনিকীকরণ অত্যন্ত জরুরি। কৃষি কাজের আধুনিকীকরণ অনেকাংশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ওপর নির্ভরশীল যা কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বপ্ন নিয়ে হাওর উন্নয়ন বোর্ডের গোড়াপত্তন করেছিলেন তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরে রূপান্তরের মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনারবাংলা বিনির্মাণে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করছেন।

হাওরে সমন্বিত কৃষির যান্ত্রিকীকরণকে এগিয়ে নিতে এবং কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বরাদ্দ করেছেন। এইসব কর্মসূচিতে সরকার যে টাকা দিচ্ছে তা সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

স্থানীয় পর্যায়ে কৃষিযন্ত্রপাতিসমূহ মেরামতের জন্য প্রশিক্ষিত সার্ভিস প্রোভাইডার তৈরি কৃষিযান্ত্রিকীকরণকে এগিয়ে নিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। প্রয়োজনে তাদের জন্য ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।

সর্বোপরি, হাওরের স্থিতিশীল ইকোসিস্টেমকে ব্যাহত না করে বর্তমান সরকারের পরিকল্পিত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হাওর কৃষিকে লাভজনক, বানিজ্যিকীকরণ ও আধুনিকায়ন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে কৃষিসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

লেখক: পরিচালক, আইকিএসি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।