পথিক রহমান
রাজনীতিতে সংলাপ একটি চমৎকার শব্দ। যেকোন সংকট, সমস্যায় সংলাপের কথা হরহামেশাই শোনা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই সংলাপ বরাবরই সময়ক্ষেপণ ছাড়া অর্থবহ কোন সমাধান আনেনি। অতীত অভিজ্ঞতা তাই-ই বলে। দেশের রাজনীতি যখনই নির্বাচনমুখি হয়, তখনই সংলাপের কথা জোরোশোরে আলোচনা হয়।
২০০৬ সালে দেশ যখন নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে গভীর সংকটে নিমজ্জিত তখন দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট এবং প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের মধ্যে সংলাপ নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়। দেশি-বিদেশি হস্তক্ষেপে ওই সময় প্রধান দুই দলের মহাসচিব ও সাধারণ সম্পাদক পর্যায়ে সংলাপ শুরু হয়।
বিএনপির পক্ষে দলের তৎকালীন মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া এবং আওয়ামী লগের সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল জলিলের মধ্যে সংলাপ শুরু হয়। দিনে-রাতে, সকালে-বিকালে চলতে থাকে এই সংলাপ। পুরো দেশ তাকিয়ে দুই দলের শীর্ষ দুই নেতার দিকে। সংলাপ শেষে তারা আশার কথা শুনাবেন। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর হবে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংঘাত-সংঘর্ষ এড়ানো যাবে। মানুষ হাঁসফাঁস অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু মান্নান-জলিল সংলাপে মানুষের সেই আশার প্রতিফলন ঘটেনি। দিনের পর দিন সংলাপ করে চায়ের টেবিলে ঝড় তুললেও সংকট সমাধানে কোনো কার্যকর সমাধান বের করতে পারেনি। এর প্রধান এবং একমাত্র কারণ ছিলো দুই দলের মহাসচিব ও সাধারণ সম্পাদক যার যার সিদ্ধান্তে অনঢ় থাকা।
এখানে বলে রাখা ভালো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির মুখে বিএনপি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটার বিহীন নির্বাচন করে মাত্র কয়েকদিনের জন্য সরকার গঠন করে। সেই সরকার বিরোধীদের দাবির মুখে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে। এতে বলা হয়, পর পর তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। এই বিল পাসের পর বিএনপি ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ সংসদ বিলুপ্ত করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে।
এরপর যথারীতি ২০০১ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার কোনরকম বিতর্ক ছাড়াই শান্তিপূর্ণ ও স্বতঃস্ফুর্তভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেয়।
২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। পাঁচ বছর সময় পার করে যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করবে ঠিক তার আগে নিজেদের পছন্দের প্রধান বিচারপতির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য বিচারপতির বয়স বাড়িয়ে নেয় জোট সরকার। তখনই শুরু হয় বিতর্ক। আওয়ামী লগিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কোনোভাবেই বিএনপির এই তৎপরতাকে মেনে নিতে পারেনি। তারা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। তীব্র আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট তাদের পছন্দের বিচারপতির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেনি। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য শুরু হয় রাজনৈতিক সংলাপ। দেশি-বিদেশি হস্তক্ষেপে দুই দলের মহাসচিব ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে সংলাপ শুরু হলেও ইতিবাচক কোনো ফল আসেনি। এক পর্যায়ে খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন আহম্মদকে প্রধান উপদেষ্টা করে তার মনোনীত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এমন পরিস্থিতি দেশে একটা অস্থিরতা তৈরি হলে ফখরুদ্দিন-মঈন ইউ আহমদের নেতৃত্বে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হয়। যা ওয়ান-ইলেভেন নামে পরিচিত।
এই যে নিজের কোর্টে বল রেখে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সরকার সংলাপ-সংলাপ নাটক করে শেষ পর্যন্ত সবকিছুকে ভায়োলেট যখন নিজেদের রাষ্ট্রপতি দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার করলেন, তখনই কার্যত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কবর রচনা হয়ে যায়।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ছেঁটে ফেলে। ফলে এই ব্যবস্থা নিয়ে আর কোনো আলোচনা বা কথা বলার সুযোগ নেই।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বার বার বলে আসছে নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী। এর বাইরে তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকারের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো গত কয়েক বছর ধরেই তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। সরকার তাদের সব দাবিকে আমলে নিলেও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছে।
এই অবস্থায় বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে দেশি-বিদেশিদের কুটনীতিকদের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশ সফর করে গিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে তারা রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে একটা অর্থবহ সংলাপের তাগিদ দিয়েছে। অপরদিকে বিএনপি নেতৃত্বও সংলাপের কথা বলছেন।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে, কোন সংলাপ নয়। নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ি। এর বাইরে কোনো আলোচনা হবে না। এরমধ্যে গত দুই দিন সধরে সংলাপের বিষয়টি আবারও আলোচনা এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী প্রতিনিধি দলের প্রতিবেদনের পর। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি যদি শর্ত ছাড়া সংলাপে বসতে চায় তাহলে হতে পারে। সরকারের অন্য মন্ত্রীরাও বলেছেন, সংলাপে বসা যায়, তবে কোনো শর্ত দিয়ে নয় আর কিভাবে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন সে বিষয়ে সংলাপ বা আলোচনা হতে পারে। এর বাইরে কোনো আলোচনা হবে না।
অপরদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও বিএনপির অন্য শীর্ষ নেতারা বলছেন, তারা সসংলাপে বসতে রাজি। তবে শর্তসাপেক্ষে। বৃহস্পতিবার বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, আমরা আলোচনার পক্ষে। কিন্তু নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারসহ কয়েকটি এজেন্ডা ছাড়া আলোচনা অর্থবহ হবে না।
এই যখন অবস্থা তখন এটা স্পষ্ট যে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার বা তত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে যদি সংলাপ হয় সেটা হবে সত্যি সত্যিই অর্থহীন। কারণ সরকার সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো আলোচনা করবে না। আর বিএনপিও তাদের অবস্থান থেকে নড়বে না। তার মানে হচ্ছে- সংলাপ হবে শুধু লোক দেখানো এবং সময়ক্ষেপণ মাত্র। অতীত অভিজ্ঞা তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
২০০৬ সালে যদি বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে আনতে প্রধান বিচারপতির বয়স না বাড়াতো এবং ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ যেমন বিনাবাক্যে নির্ধারিত সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল, সেভাবে বিএনপি-জামায়াত জোট যদিও ২০০১ এ ক্ষমতা হস্তান্তর করতো তাহলে আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না।
তাছাড়া, তত্ত্বাবধায় সরকার ব্যবস্থা যেহেতু উচ্চ আদালতই বাতিল করে দিয়েছে সেহেতু এই ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনারও কোনো সুযোগ নেই। এখন আলোচনা হতে পারে কিভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে এবং সকল দল ও ভোটারের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করা যায় সে নিয়ে। এর বাইরে নিরপেক্ষ সরকার বা এই জাতীয় কোনো ইস্যুতে আলোচনা বা সংলাপ গুরুত্ত্বহীন এবং কথার কথা।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।