গাজী মনসুর

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আরব রাষ্ট্রগুলো পাকিস্তানের সঙ্গে ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পাকিস্তানকে তারা সহায়তা দিয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি খুব দরকার ছিল। ওই সময় অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ইসরায়েল বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করে। এটা ছিল সদ্য স্বাধীনতা একটি দেশের জন্যে খুবই সাহসী সিদ্ধান্ত। তবু কাজটি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

আজও বাংলাদেশ ফিলিস্তিন ইস্যুতে বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্র নীতিতে অটল। শেখ হাসিনার সরকার বিশ্বাস করে, বাংলাদেশ সবসময় মানবাধিকার ও মানবিকতারে পক্ষে। এটা শুধু সহিংসতা, দখলদারি, ফিলিস্তিন বা মুসলিম সম্পর্কিত বিষয় নয়। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ে সংগ্রামরত মানুষকে সব সময় সমর্থন দিয়েছেন। তাই ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান ও দ্বিরাষ্ট্র নীতির ভিত্তিতে একটি স্বাধীন ও টেকসই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবির পক্ষে উচ্চকিত ছিলেন তিনি।

এরই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার রক্ষায় এবং জাতিসংঘ প্রস্তাব, আরব পিস ইনিশিয়েটিভ ও কোয়ার্টেট রোডম্যাপের আলোকে স্বাধীন, সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ফিলিস্তিন সংকটের একটি টেকসই এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।

সম্প্রতি সংঘটিত সকল ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতে এবং যেকোনো সংকট নিরসনের জন্য গৃহীত পদক্ষেপে ফিলিস্তিনের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছে বাংলাদেশ। অনেক মুসলিম দেশ এরইমধ্যে ফিলিস্তিনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে কিংবা গোপনে ইসরায়েলের সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক তৈরি করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ বিশ্বাসভঙ্গ কিংবা কোনো ভান-ভনিতার আশ্রয় নেয়নি। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ ইসরায়েলি দখলদারি ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে অটল রয়েছে।

ঐতিহাসিক ভাবে বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ । এখানে ১৯৭২ সালে ইসরায়েলের স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি আরও একবার উল্লেখ করতে হবে। কারণ ওই সময় ইসরায়েলের স্বীকৃতি এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্যে সহজ ছিলও না। তবু বাংলাদেশে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি জোরালো সমর্থন অব্যাহত রাখতে এবং মুসলিম উম্মাহর ক্ষতি হোক এমন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে ইসরায়েলের স্বীকৃতি গ্রহণ করেনি। তাই ওই সময় থেকে ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারির অবসান ঘটিয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা অর্জনকে সমর্থন করা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অতিগুরুত্বপূর্ণ নীতি।

আরব দেশগুলোর বেশির ভাগই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে  দ্বিধাগ্রস্ত ছিলো। কিন্তু তখনও ফিলিস্তিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাংলাদেশ ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করে। ১৯৬৭ সালের নির্ধারিত সীমানা অনুযায়ী জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে সমর্থন করে বাংলাদেশ।

ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ১৯৭৪ সালে লাহোরে ওআইসির দ্বিতীয় সম্মেলনের সময় ইয়াসির আরাফাত ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বৈঠকের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে প্রথম উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে তার প্রথম ভাষণে, ১৯৭৪ সালে ওআইসির দ্বিতীয় সম্মেলনে এবং ১৯৭৩ সালে চতুর্থ ন্যাম সম্মেলনে ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রাম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান।

১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে মেডিক্যাল টিম ও ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সহায়তা করে। ঢাকায় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-এর কার্যালয় স্থাপনের অনুমতি প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও পিএলওর মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়।

উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি ফিলিস্তিনে, পবিত্র আল-আকসার জন্য সশরীরে লড়াই করেছে। যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের লাইব্রেরির ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, ১৯৮৭ সালে প্রায় আট হাজার বাংলাদেশি যুবক পিএলওতে যোগ দিয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে লড়াই করেছে। ১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ঘোষণার পর থেকে জাতিসংঘের যে ১৩৮টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। ১৯৮০ সালে একজন ফিলিস্তিনি যোদ্ধার ছবিসংবলিত ডাকটিকিটও প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ যেমন ইসরায়েলের স্বীকৃতি গ্রহণ করেনি তেমনি গত ৫০ বছরে ইসরায়েলকেও বাংলাদেশ স্বীকৃতি দেয়নি। উপরন্তু, বাংলাদেশি নাগরিকদের ইসরায়েল ভ্রমণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে সব রকম বাণিজ্য (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ) সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্কও নেই।

এখনও বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের সাথে ফিলিস্তিনের জনগন ও সরকারের সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ফিলিস্তিনি ছাত্রদের বাংলাদেশের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ফিলিস্তিনের সামরিক সদস্যদের বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সামরিক সম্পর্কও তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ক্রমাগত ও জোরালো সমর্থক এবং ইসরায়েলের দখলদারির বিরোধিতাকারী। এরই ধারাবাহিকতায় ইসরায়েলের চলমান বর্বরোচিত আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী লিখিতভাবে প্রতিবাদ করেছেন। বর্তমানে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলার বিষয়টি সুরাহা করতে বাংলাদেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ২০২১ সালে ইসরায়েলি হামলায় হতাহত ব্যক্তিদের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানিয়ে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাসকে চিঠি পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চিঠিতে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি আল-আকসা মসজিদ কমপ্লেক্সে নিরীহ মুসলমান এবং বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার গভীর দুঃখ এবং উদ্বেগ প্রকাশ করছি।’ ফিলিস্তিনসহ সারা বিশ্বের যেসব স্থানে এই ধরনের ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলো বন্ধে টেকসই ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিও আহ্বান জানান তিনি।

শেখ জাররাহ এলাকা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে ইসরাইলের দখলের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করে সেই এলাকা দখল করে ইসরাইলি বাহিনী মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন করেছে’। চিঠিতে ফিলিস্তিনের রাজধানী পূর্ব জেরুজালেমসহ ১৯৬৭ সালের সীমান্তের ওপর ভিত্তি করে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থানও পুনর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।

এর আগে ২০২০ সালে এবং পরে ২০২২ সালেও একই ভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন চিঠি দিয়েছিলেন। গত পাঁচ দশক ধরে ফিলিস্তিনের বেশ কয়েকটি অঞ্চল দখল করে রেখেছে ইসরায়েল। যে কারণে ইসরায়েলকে কি ধরনের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের (আইজিসে) মতামত জানতে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। এই প্রস্তাবের পক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৮৭টি দেশ ভোট দিয়েছে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।