মিনার সুলতান

চলমান অক্টোবর মাসের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ‘অক্টোবর বিপ্লব’ বলতে চাইছে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমানের গড়া দল বিএনপি। মিটিং-মিছিলের পাশাপাশি ছাত্র কনভেনশন গণঅনশন ইত্যাদির ডাক দিয়েছে অতীতে ছাত্ররাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের দায়ে অভিযুক্ত দলটি। নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের শাসনক্ষমতা নেয়ার পথ ছেড়ে বিশৃঙ্খলার পথে চলতে থাকা বিএনপি কোন অবস্থান থেকে তাদের বর্তমান কার্যক্রমকে বিপ্লব বলতে চাইছে তা বোঝার জন্য একটু পেছনে ফিরে দেখা দরকার।

ইতিহাসের জ্বলজ্বলে ইভেন্ট ‘অক্টোবর বিপ্লব’এর কথা উঠলে সবারই মনে আসে অত্যাচারী সম্রাট জার নিকোলাসের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার সূচনা ঘটানো। ‘বলশেভিক বিপ্লব’ নামেও পরিচিত শ্রমিক শ্রেণির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে বিএনপি এই প্রথমই যে নিজেদের কর্মসূচির সঙ্গে গুলিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে এমন নয়। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের কলঙ্কজনক নৃশংস ইতিহাসকে ব্যবহার করে কিছুদিন আগে নিজেদের মিত্রদের মাঝে গুপ্তবার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছে জিয়াউর রহমানের পুত্র তারেক রহমান। সেই ৭ নভেম্বরে মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল হুদা, মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল হায়দারসহ বহু সৈনিক ও সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের পথ পরিষ্কার করা হয়। ক্ষমতা পেয়েই জিয়াউর রহমান বাছাই করে করে মুক্তিযোদ্ধা নিধন করা শুরু করে।

ঐতিহাসিক অক্টোবর বিপ্লবের তারিখ তৎকালীন জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ২৪-২৫ অক্টোবর। শুনতে অবাক লাগলেও বাস্তবতা হলো, তারিখটি বর্তমানে পুরো পৃথিবীতে স্বীকৃত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ৬ ও ৭ নভেম্বরেই পড়েছে। অনেক ভেবেচিন্তেই কি ‘অক্টোবর বিপ্লব’ নামটি বেছে নিয়েছে বিএনপি?

অক্টোবর নিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া বা ১৯৪৯ সালে চীনের সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের মতো মহিমান্বিত ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে বিএনপি যতই তার দুরভিসন্ধিমূলক রাজনীতিকে গুলিয়ে জনতার সামনে আনতে চেষ্টা করুক, আমাদের দেশেই দলটি ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে দেশজুড়ে যে ভয়াবহ ইতিহাস তৈরি করে রেখেছে তা ছাপিয়ে চীন-রাশিয়ার গল্প দেশবাসীর মনে জাগে না।

২০০১ সালের বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের পর সনাতন ধর্মাবলম্বীরা জামায়াত-বিএনপির সমর্থকদের দলগত অত্যাচারের শিকার হন, সেই কলঙ্কজনক অধ্যায় বাংলাদেশের পক্ষে কখনোই ভোলার নয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পদ লুটপাট-দখল করা, তাদেরকে দেশছাড়া করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত হামলা তো দেশজুড়ে সাধারণ ঘটনায় পরিণত করা হয়েছিলো তখন। ২০০১ সালের অক্টোবরজুড়েই ৫ শতাধিক দমন-পীড়নের ঘটনা ঘটেছিলো।

৮ অক্টোবর ২০০১এ প্রকাশিত আজকের কাগজ থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামের রাউজান নোয়াপাড়া ডিগ্রী কলেজে ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে ৫ ছাত্রলীগ কর্মীকে আহত করে।

সেই সময় বিএনপির দখলদারিত্ব থেকে বাদ যায়নি বাস-লঞ্চ টার্মিনালও। সাতক্ষীরার তিনটি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন দখলে নিয়েছিল দলটির লোকজন। ২০০১ সালের ৯ অক্টোবর ওই ঘটনা ঘটায় তারা। একই দিনে ঝালকাঠিতে একটি লঞ্চ টার্মিনাল, একটি বাস কাউন্টার ও মাছের বাজার এবং নারায়ণগঞ্জ বালুঘাট দখল করে দলটির নেতা-কর্মীরা। ওই সব হাট এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের তাড়িয়ে দিয়ে হাটের নিয়ন্ত্রণ নেয়া হয়। দৈনিক প্রথম আলোতে এ সংক্রান্ত খবর ২০০১ সালের ১১ অক্টোবর প্রকাশিত হয়।

অষ্টম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে জয় পাবার আগেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলো জামায়াত-বিএনপি জোট। গৌরনদী আগৈলঝাড়ায় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন ও সন্ত্রাস শুরু করেছিলো নির্বাচনের আগ থেকেই। নির্বাচনের পর তা আরো বাড়িয়ে দেয় সন্ত্রাসীরা। ওই এলাকায় সনাতন ধর্মাবলম্বী আর আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা নির্যাতনের শিকার হন। অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ঘর ছাড়েন, দেশও ছাড়েন বলে জানা যায়। গৌরনদী-আগৈলঝাড়া থানার বিভিন্ন গ্রামে লুট-পাট, অগ্নিসংযোগ ও শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে। চাঁদাবাজি, লুটপাট, ধর্ষণসহ গরু ছাগল পর্যন্ত লুট করার ঘটনাও ঘটেছিলো তখন। জামায়াত-বিএনপির এমন পাশবিকতার খবর প্রকাশিত হয়েছিলো ১২ অক্টোবর ২০০১এ আজকের কাগজ পত্রিকায়।

২০০১ সালের ১২ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, বরিশালের হিজলা উপজেলার ধুলখোলা বাজারের ক্ষুদ্র সেলুন ব্যবসায়ী নিতাই শীল বৃদ্ধা মায়ের সৎকার করতে পারেননি। ধর্মীয় বিধান অনুসারে মায়ের মৃত্যুর পর শেষকৃত্যে যোগ দিতে পারেননি তিনি। বিএনপির সন্ত্রাসীরা তাকে গ্রামছাড়া করে রেখেছিলো। নিতাইয়ের অপরাধ ছিলো, তিনি আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছিলেন।

২০০১ সালে ক্ষমতা নিশ্চিত করে তার পুরোটাই সহিংসতায় কাজে লাগিয়েছিলো জামায়াত-বিএনপি জোট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখলের পর আধিপত্য নিয়ে ছাত্রদলের বিভিন্ন গ্রুপে সংঘাত দেখা দিয়েছিলো তখন। সেই বছরের অক্টোবরে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের সশস্ত্র ক্যাডারদের অব্যাহত হুমকি ও হামলার কারণে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের দেড় শতাধিক নেতাকর্মী ছাত্রাবাস ও কলেজ ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী তখন পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি বলেও ১২ অক্টোবরে প্রকাশিত যুগান্তর পত্রিকা থেকে জানা যায়।

১২ অক্টোবরের যুগান্তর পত্রিকা প্রকাশ করে, পটিয়ায় একটি আওয়ামী লীগ অফিস গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। উপজেলার শিকলাবাহা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ অফিস গুঁড়িয়ে দিয়ে সন্ত্রাসীরা সেখানে রক্ষিত বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাংচুর ও মালামাল লুট করে।

জামায়াত-বিএনপি চার দলীয় জোট ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতা পেয়েই নির্বাচিত আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেশবরেণ্য নাট্যশিল্পী আসাদুজ্জামান নূরকে হত্যার চেষ্টা চালায়। ১২ অক্টোবর ২০০১ তারিখে যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তাঁর বাড়িতে বোমা হামলা চালানো হলেও অল্পের জন্য বেঁচে যান আসাদুজ্জামান নূর।

শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জে বিএনপির নির্বাচন পরবর্তী অত্যাচার চলে সপ্তাহব্যাপী। ১২ অক্টোবর ২০০১ তারিখে বিএনপি নেতা হুমায়ুন খানের নেতৃত্বে একদল ক্যাডার আওয়ামী লীগের একজন সমর্থকের বাড়িতে চাইনিজ কুড়াল, রামদা ও সরকি নিয়ে হামলা চালিয়ে তার পরিবারে ৫ জনসহ ৮ জনকে গুরুতর আহত করে। এ ছাড়াও সেই সময় আরও সহিংস ঘটনায় ৩ ব্যক্তি নিহত ও শতাধিক আহত হয় বলে পরের দিন জনকণ্ঠ পত্রিকা থেকে জানা যায়। সনাতন ধর্মাবলম্বীরাসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ছিলো তখন প্রায় প্রতিদিনের।

সেই দুঃসহ কালে হাজী মোহাম্মদ দানেশ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের বহিরাগত কর্মীদের মহড়া চলতো। দেড় শতাধিক সাধারণ ছাত্রছাত্রী আতঙ্কে হল ছেড়ে গেছে তখন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রাণ ভয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলো। তাদেরকে দা দিয়ে কুপিয়ে জখম করা, তাড়া করে দুই পা ভেঙে দেয়ার ঘটনা লেখা আছে ১৩ অক্টোবর ২০০১এর যুগান্তর পত্রিকায়।

১৩ অক্টোবর ২০০১ তারিখে প্রকাশিত জনকণ্ঠ পত্রিকায় মুন্সীগঞ্জে বিএনপির তাণ্ডবের ভয়ঙ্কর খবর উঠে এসেছে। সদর উপজেলার আধারানগর ডুসবা গ্রামে এক নিরীহ যুবতীকে ধর্ষণ করে স্থানীয় বিএনপির নাসির মোল্লা ও তার অনুসারীরা।

রাজশাহীর তানোর উপজেলায় ৩৬ বছর বয়সী নরেশচন্দ্র দাস নামের একজনকে আওয়ামী লীগ করার অপরাধে জীবন দিতে হয়। পুঠিয়া উপজেলায় আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থী তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুকের ওপর সশস্ত্র হামলা হয়। তিনি দৌড়ে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পেলেও হামলাকারীরা তার গাড়ি ভাংচুর করে ও তার ড্রাইভার দুলালকে আহত করে। রাজশাহীর কাজলা এলাকায় সন্ত্রাসীদের হামলায় একজন আওয়ামী লীগ নেতা আহত হন। সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলায় হামলার ঘটনায় অন্তত ১০ জন আহত হন। নোয়াখালীর সুধারাম থানার নরসিংপুর গ্রামে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িতে ভাংচুর ও লুটপাট হয়েছে। সন্ত্রাসীরা বাড়ির মেয়েদেরও লাঞ্ছিত করে। সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলায় আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে প্রহার করা হয়। ১৩ অক্টোবর ২০০১ শনিবার যুগান্তর পত্রিকায় এসব সংবাদ প্রকাশিত হয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর জামায়াত-বিএনপির আক্রোশ দেখা গেছে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনোত্তর কালে। সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় চারটি সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে ভাংচুর, কর্মরত কর্মকর্তাদের অপমান করার ঘটনা ঘটেছিলো। ১৩ অক্টোবর ২০০১ তারিখে প্রকাশিত আজকের কাগজ পত্রিকায় লেখা আছে ভয়ঙ্কর সেইসব দিনের কথা।

অষ্টম জাতীয় নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় নারায়ণগঞ্জেও ঘটেছিলো হতাহতের ঘটনা। বাড়িঘরে হামলা ও ভাংচুর তো হয়েছেই। হাত-পা কেটে ফেলার মতো অমানবিক নির্যাতনও চালানো হয়েছে। সন্ত্রাসীরা বিএনপির বিজয় উপলক্ষে দর্জি দীলিপ সরকারের কাছে চাঁদা চেয়ে না পেয়ে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। আওয়ামী লীগ নেতা এখলাসকে কুপিয়ে তার ডান হাত এবং পা কেটে ফেলা হয়। যুগান্তর পত্রিকায় ১৪ অক্টোবর ২০০১ তারিখে এসব খবর প্রকাশিত হয়।

দুঃসহ এমন ঘটনা অনেক আছে। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত নিজের মত ধারণ ও প্রকাশের ‘অপরাধে’ হাজার হাজার মানুষের ওপর রাষ্ট্রীয় মদেদ যে ভয়াবহ সন্ত্রাস চালানো হয়েছে, বিভিন্ন পত্রপত্রিকার তথ্য আমলে নিলেই তার সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজারেরও বেশি। এমন নির্মম কালযুগের জন্ম দেয়া জামায়াত-বিএনপি সিন্ডিকেট দেশি-বিদেশি মদদে নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচনকে বানচাল করতে ‘অক্টোবর বিপ্লব’কে কলঙ্কিত করে ২০০১এর মতো আবার কোন ব্ল্যাক অক্টোবরের জন্ম দিতে চলেছে? এই প্রশ্ন এখন অনেকের মনে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।