গাজী মনসুর

২০২৩ এর অক্টোবরে তাদের একদফা আন্দোলনের পরিণতি দেখতে চায় বিএনপি । এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়ে যুগপৎ আন্দোলন চূড়ান্ত ধাপে এগিয়ে নেয়ার কৌশল ঠিক করছে দলটি। সেই লক্ষ্যে তারা মাঠেও নেমেছে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে বার্তাও দেয়া হয়েছে সারা দেশের কর্মীদের। রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রশ্ন আসে অক্টোবর টার্গেট কেন?

খুব স্বাভাবিক কারণ হচ্ছে, দেশে খুব বড় কোন ডামাডোল সৃষ্টি না হলে নভেম্বরের ১ তারিখ থেকে জাতীয় নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হবে। নির্বাচন কমিশনকে ভোট করতে হবে ২০২৪ এর ২৯ জানুয়ারির মধ্যে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর একবার তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে নির্বাচনও হয়ে যাবে। তাই আপাতত নির্বাচন ঠেকানোর প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে তারা তফসিল ঠেকাতে চাইছে।

আমাদের স্যাংশন বন্ধুরা বিষয়টি আমলে এনেছেন কী না আমি জানিনা। কিন্তু এই অক্টোবরের আন্দোলন কর্মসূচির যে ঘোষণা, এর মধ্যে কিন্তু নির্বাচনে বাধা দেয়ার বিষয়টি পরিস্কার। রাজনৈতিক দাবি হচ্ছে, একটি সাংবিধানিক সরকার নির্বাচনের আয়োজন করবে। সেই নির্বাচনে সবাই অংশ নেবে। দেখার বিষয় হচ্ছে সেই নির্বাচন কতটা অংশগ্রহণ মূলক হচ্ছে? মানুষ ভোট দিতে পারছে কী না? এর ওপর নির্ভর করবে নির্বাচন সুষ্ঠু কী সুষ্ঠু নয়।

আমি আগেই বলে দিলাম, ওরা নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে না। একবার নিজেরা নির্বাচনে না গিয়ে এবং আরেকবার গাছাড়া নির্বাচন করে বলে দিলাম ওরা সুষ্ঠু নির্বাচন করে না। পাশাপাশি নির্বাচন সম্পর্কে দেশে বিদেশে মিথ্যাচার করতে থাকলাম। অবাধ তথ্য প্রবাহের এই যুগে একটি প্রমাণ না দিয়েই বললাম দিনের ভোট রাতে হয়েছে। এর কোনটাই রাজনীতি চর্চা নয়। রাজনীতির সঙ্গে সত্যের যে একটা সম্পর্ক আছে সে বিষয়টি আমরা ভুলেই গেছি মনে হয়। 

২০১৪ থেকে যে অবিশ্বাসের রাজনীতি শুরু হয়েছে আজ পর্যন্ত তা বহাল। অথচ ওই সময় যদি বিএনপি নির্বাচনে আসতো তাহলে আজ প্রতিটি মানুষের যে অনাকাঙ্ক্ষিত স্নায়ুবিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, সেটা থেকে রেহাই পাওয়া যেতো। কিন্তু তখনও অতীতমুখী হয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সেই নির্বাচনে আসেনি। সরকার কিন্তু সেসময় অতীতমুখী হয়নি। দেশের ভোটাররাও হননি।

আসলে আমাদের দেশের মানুষ মৌলিকভাবে খুবই ভালো। তারা দ্রুত সবকিছু ভুলে যায়। তাই আজ যে অক্টোবরে দাড়িঁয়ে বিএনপি এক দফার আন্দোলন সফল করার কথা ভাবছে ২০০১ সালের সেই অক্টোবরের কথা ভাবলে অনেক কিছু পরিস্কার হয়ে যায়। ওই মাসের প্রথম দিনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পুরো পাঁচ বছরের শাসমলে না গিয়ে শুধু ওই একটি মাসের কিছু উদাহরণ দিতে চাই। 

২০০১ সালের ১লা অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় নির্বাচনের ঠিক পর দিন থেকে, মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। শুধু নৌকায় ভোট দেয়ার কারণে হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের শিকার হন সারা দেশের সংখ্যালঘু থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পরে যেভাবে ঘর-বাড়ি-গ্রাম ছেড়ে পালানোর ঢল নেমেছিল, মানুষ হয়েছিল শরণার্থী, ঠিক একই অবস্থার সৃষ্টি করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশে বিএনপি-জামাতের নেতাকর্মীরা।

পরে এনিয়ে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন হয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় ১৪ হাজার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিশন ৫ হাজার ৫৭১টি অভিযোগের তথ্য প্রমাণ খুঁজে পান। এর মধ্যে হত্যার ঘটনা ছিল ৩৫৫টি।  ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ গুরুতর অপরাধের ৩ হাজার ২৭০টি ঘটনা চিহ্নিত করা হয়।  

পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু নৃশংস ঘটনার বিবরণ নিচে দেয়া হল, যার উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ পেয়েছিল বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন। আপাতত এর মধ্যে থেকে এই লেখায় শুধু অক্টোবরের কথা উল্লেখ করবো। কারণ সেটাই ছিল শুরু। 

ভোলা

লালমোহন থানার লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউপির অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের ‘ভেন্ডারবাড়ি’তে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন-নিপীড়নের কারণে পরিচিত হয় সারা বিশ্বে। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় প্রশাসনের লোকজন এমনকি সংবাদ কর্মীরাও ঠিকঠাক তথ্য সংগ্রহ করতে পারেননি। অনেকেই ঘটনার বিবরণ দিয়ে নাম-ঠিকানা প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করেন তদন্ত কমিশনকে। নির্বাচনের পর ২রা অক্টোবর অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের আশেপাশের গ্রামের সংখ্যালঘু নারীরা নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন গ্রামের চারপাশের ধানক্ষেত ও জলাভূমি ঘেরা ভেন্ডারবাড়ি । কিন্তু সেটি সন্ত্রাসীদের নজর এড়ায়নি।

শত শত বিএনপি সন্ত্রাসী ৮-১০টি দলে বিভক্ত হয়ে পরিকল্পিতভাবে রাত আনুমানিক ১০.০০ টার দিকে, পালাক্রমে হামলা করে। নারীরা সম্ভ্রম হারানোর ভয়ে, ঝাঁপিয়ে পড়েন আশ-পাশের জলাশয়ে। তখন তাঁদের শিশুদের পানিতে ছুঁড়ে ফেলার হুমকি দিয়ে পানি থেকে উঠে আসতে বাধ্য করে সন্ত্রাসীরা। ওই রাতেই ধর্ষিত হয় আট বছরের শিশু, লাঞ্ছিত হন ৬৫ বছরের বৃদ্ধা; মা, মেয়ে, শাশুড়ি, পুত্রবধূ একসাথে। সেদিন ধর্ষকরা ছাড়েনি পঙ্গু নারীকেও।

লালমোহনের পশ্চিম চরউমেদ ইউনিয়নের জাহাজমারা গ্রামে দুপুরের পর যখন হামলা হয় তখন, সন্তান জন্মের প্রসব বেদনা উঠেছিল এক গৃহবধূর। বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর মাতব্বরের নেতৃত্বে অর্ধশতাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী দা, ছুরি, লাঠি ও বল্লমসহ হামলা চালায় তাদের কুঁড়ে ঘরে। চারদিকে তখন চলছে লুটপাট। ভয়ে পালাচ্ছে গ্রামবাসী। সন্ত্রাসীদের ভয়ে পালিয়ে যান ওই নারীর ধাত্রী। এরমধ্যে জন্ম নেয় একটি পুত্র সন্তান। ওই সন্তানের নাড়ী না কেটেই সিদিন পালাতে হয়েছিল মেয়েটির।  

মাগুরা

নির্বাচনের পর ২০০১ সালের ৯ই অক্টোবর মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার সব্দালপুর ইউনিয়নের নহাটা গ্রামের পালপাড়ায় হামলা করেছিল বিএনপি নেতা বাকি মিয়া। সঙ্গে ছিলো, মিজানুর রহমান, জাহাঙ্গীর, বাবলু, আবু সাইদ, কেনাল সহ ২০/২৫ জন। কয়েকটি বাড়িতে ভাংচুর, মারপিট ও লুটপাট করে তারা। এক পর্যায়ে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া দুই তরুণীকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে সারারাত নির্যাতন চালায়। পরের দিন নারী ও শিশু নির্যাতন ধারায় মামলা হয় এবং তদন্ত শেষে আসামীদের বিরুদ্ধে চার্জশিটও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০০২ সালে জোর করে পাশের আমতৈল দাখিল মাদ্রাসায় বিএনপি-জামায়াতের নেতারা একটি আপস মীমাংসা করার চেষ্টা করে। সেখানে ওই দুই তরুণীর পরিবারকে ১৯ হাজার ৫ শত টাকা দিয়ে মামলা তুলে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।

সেই অক্টোবর থেকে শুরু করে ২০০৬ পর্যন্ত সারা দেশছিল এরকম বহু টার্গেটেড হামলার নরককুণ্ড। বিএনপি-জামায়াতের প্রতিহিসংসার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোশকতায় শুরু হয় জঙ্গিবাদের উত্থান। একের পর এক হামলা। ভয়ঙ্কর সেই সব দিনের পথ ধরে চলে আসে ২০০৪ এর ২১শে আগস্ট। বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার সর্বোচ্চ চেষ্ট। আইভি রহমানের মত নেত্রীসহ ২২ জনের মৃত্যু। চিন্তা করা যায়? পাঠক আপনাদের কাছে জানতে চাই, এর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে, তাদের নেতা কর্মীরা কী এমন সব অমানবিক চর্চার ধারে কাছে গিয়েছিল? তাহলে তাদের অধীনে নির্বাচন হতে বাধা কোথায়? ২০০১ এর অক্টোবর থেকে সহিংসতা শুরু না হলে কী রাজনীতি থেকে বিশ্বাস হারাতো?

আজ পৃথিবীর সবাই বলছেন, নির্বাচনই শান্তির পথ। সেই পথে না গিয়ে বিএনপি আরও একটি অক্টোবরের দিকে হাঁটছে। অথচ নির্বাচন নিয়ে আমাদের আজকের যে অচলাবস্থা এর জন্যে দায়ী কিন্তু বিএনপি সৃষ্ট ২০০১ এর অক্টোবর। তারা ভুলে যাচ্ছেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে নানা অনিয়ম চলে আসে। বহু অসৎলোক ঢুকে পড়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে। এত দিন এই দায় সরকারকেই নিয়েছে। অবাধ তথ্য প্রযুক্তির যুগে কিছুই লুকিয়ে রাখা যাবে না। এবার সব পরিবেশ থাকা সত্বেও নির্বাচনে না এলে সুষ্টু নির্বাচন না হওয়ার দায় বিএনপিকেও নিতে হবে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।