নিজস্ব প্রতিবেদক

মাংসের পরিবর্তে কাঁঠালের নানামুখী ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনা। তার মতে, উন্নত বিশ্বের মানুষরা মাংসের পরিবর্তে কাঁঠালের তৈরি কাবাব, বার্গার, রোল ইত্যাদি খেয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর ই কথা অনেকেই অবাস্তব মনে করেছিলেন। তার বক্তব্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে নানা সমালোচনাও কম হয়নি। এমনকি ট্রল করতেও পিছপা হয়নি কেউ কেউ। তবে এটি সত্য যে, বাংলাদেশ থেকে কাঁঠালের বার্গার রফতানি হচ্ছে ইউরোপের বাজারে। আইসল্যান্ডের একটি সুপারস্টোর বাংলাদেশ থেকে চার লাখ কাঁঠালের বার্গার নেওয়ার অর্ডার দিয়েছে।

গত ডিসেম্বরে গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাঁঠালের জিনোম সিকোয়েন্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এই অঞ্চলে (গাজীপুরে) প্রচুর কাঁঠাল উৎপন্ন হয়। উন্নত বিশ্বে এখন মাংস খেতে চায় না। তারা মাংসের পরিবর্তে কাঁঠালের তৈরি কাবাব, বার্গার, রোল ইত্যাদি খাচ্ছে। কাঁঠালের তৈরি এসব খাবারের দামও কিন্তু অনেক বেশি। এসব খাবারের ব্যাপক চাহিদাও রয়েছে। আমাদের দেশের উচ্চ বিত্তরা বার্গার, রোল জাতীয় খাবার খেতে পছন্দ করেন। এসব খাবারে মাংসের পরিবর্তে কাঁঠাল ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাঁঠালেও অনেক পুষ্টিগুণ রয়েছে। কাঁঠালের কোনও অংশই ফেলনা নয়।

তার বক্তব্যের পরই নেটিজেনরা নানা সমালোচনা শুরু করেন। তবে বাংলাদেশ থেকে রফতানির তালিকায় যুক্ত হলো কাঁঠালের বার্গার। সম্প্রতি ইউরোপের দেশ আইসল্যান্ড থেকে ৪ লাখ পিস কাঁঠালের বার্গারের ক্রয়াদেশ পেয়েছে বাংলাদেশ। আইসল্যান্ডের চেইন সুপারশপ আইসল্যান্ড সুপারস্টোরে রপ্তানি হচ্ছে কাঁঠালের বার্গার। পল্লি কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গ্রামীণ উন্নয়ন সংস্থা পিকেএসএফের আশা, প্রক্রিয়াজাত কাঁঠালের বার্গার সারা বিশ্বের নিরামিষভোজীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করবে।

কর্মকর্তারা জানান, খাদ্য পরীক্ষাগারে গবেষকদের সাফল্যের পর বাণিজ্যিকভাবে কাঁঠালের রেসিপি নিয়ে কাজ করতে উৎসাহী হয় পিকেএসএফ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর অ্যাগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট) থেকে আর্থিক সহায়তাও মিলেছে। সংস্থাটি তার কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ এবং উদ্যোগ প্রচার প্রকল্পের অধীনে ১২৯ মিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদান করছে। জাতিসংঘের এজেন্সি-সহায়তা প্রকল্পের অধীনে বাস্তবায়িত হওয়া ছোট আকারের প্রকল্পগুলোর মধ্যে কাঁঠালের বার্গার অন্যতম।

১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ইনোভেশন অ্যান্ড প্র্যাকটিস (সিডিআইপি) নামের এনজিওটি এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পে মোট বিনিয়োগ করা হয়েছে ১ দশমিক ৮৯ কোটি টাকা। এরমধ্যে পিকেএসএফ দিয়েছে ১ দশমিক ৪৪ কোটি টাকা এবং বাকি টাকা দিচ্ছে সিডিআইপি।

সিডিআইপির নির্বাহী পরিচালক মিফতা নাইম হুদা বলেন, কাঁঠালের বার্গার উৎপাদন কারখানায় পিকেএসফ শুধু অর্থায়নই করছে না, আইসল্যান্ড থেকে যে রপ্তানি অর্ডার এসেছে, তাতেও পিকেএসএস সহায়তা করছে। আইসল্যান্ডের প্রতিষ্ঠানটি পিকেএসএফের মাধ্যমে কারখানা পরিদর্শন করতে চেয়েছে। সিডিআইপি‍ বিষয়টি মাথায় নিয়েই প্রস্তুতি নিচ্ছে।

বাংলাদেশ কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ডইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (বিসিএসআইআর)-এ ইতোমধ্যেই কাঁঠালের বার্গারের খাদ্যমান যাচাই করা হয়েছে। বিসিএসআইআর থেকে ডায়েটারি ফাইবার অ্যানালাইজারের মাধ্যমে পরীক্ষায় প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁঠালের পেটিতে ৯ দশমিক ৭৮ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ১০ দশমিক ৮৭ গ্রাম প্রোটিন, ৮ দশমিক ৪৭ গ্রাম ফ্যাট, ১৯ দশমিক ৩২ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার এবং ১৫৯ কিলোক্যালরি এনার্জি রয়েছে বলে জানা যায়।

পিকেএসএফের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদের বলেন, স্বাদ, গন্ধ কিংবা রসালো ভাবের দিক দিয়ে মাংসের পেটির বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে কাঁঠালের পেটি। বিশ্বে ভেজিটেরিয়ানদের (নিরামিষভোজী) কাছে এর চাহিদা থাকার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে, ফলে রপ্তানিতেও তৈরি হয়েছে সম্ভাবনা।

বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশে বছরে ১৮ লাখ ৯৩ হাজার ৩০৩ মেট্রিক টন কাঁঠাল উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে এ উৎপাদন ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে, পণ্য বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে সারাবছর কাঁঠালের পণ্য বিপণন সম্ভব হবে। এতে কাঁঠালের ভ্যালু অ্যাডিশন বা মূল্য সংযোজন কয়েকগুণ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পোস্ট হার্ভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও খাদ্য প্রযুক্তিবিদ ড. মো. গোলাম ফেরদৌস জানান, শুধু বার্গারই নয়– কাঁচা কাঁঠাল দিয়ে স্যান্ডুইচ, কাঁঠালের রোল, কাটলেট, সিঙ্গারা, সমুচা, কাঁঠালের দই, কাঁঠালসত্ত্ব, শরবত, কাস্টার্ড, কেক, আইসক্রিমও তৈরি করা সম্ভব। যদি সচেতনতা তৈরি করা যায় তাহলে কাঁঠালপণ্যের একটি বড় বাজার তৈরি করা যেতে পারে এবং বিদেশের বাজারেও এটি ব্যাপক রপ্তানি সম্ভাবনা তৈরি করবে। তার মতে, ম্যাকডোনাল্ড’স আমেরিকায় কাঁঠালের বার্গার বানাচ্ছে। কাঁঠাল কিন্তু আমেরিকায় খুব বেশি হয় না। শুধুমাত্র পুষ্টিগুণ এবং স্বাদ বিবেচনায় তারা কাঁঠালের বার্গার বানাচ্ছে। পিকেএসএফ ও সিডিআইপির কর্মকর্তারা জানান, বার্গারের পেটি তৈরিতে শতকরা ৫৮ ভাগ কাঁঠাল এবং ২০ ভাগ ময়দা/কর্ণ ফ্লাওয়ারের মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়েছে এবং অবশিষ্ট ২২ ভাগ উপকরণ হিসেবে পিঁয়াজ, আদা, ধনে পাতা, কারি পাউডার, চিলি পাউডার ইত্যাদির ব্যবহার হয়েছে।