আবু জাফর মিয়া
রাজ্যের সব সমস্যা মাথায় নিয়েও যিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সকল প্রকার সুখ দুঃখের খবর রাখেন; তিনি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি শুধু একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী নন, সে দেশের জনগণের জন্য একজন মমতাময়ী মা-ও বটে। শিশু থেকে শুরু করে বড়, প্রাপ্তবয়স্ক -বৃদ্ধ সকলকে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে সহায়তা করে যাচ্ছেন তিনি। কোটি কোটি মানুষকে শিখিয়েছেন আলোকিত জগতের মানে। দারিদ্র্য নিরসন থেকে শুরু করে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, গর্ভবতী ভাতা, জেলে ভাতা-র মতো অসংখ্য অনুদানের মাধ্যমে সমাজের সকল স্তরের মানুষকে তাদের দূর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছেন তিনি।
‘স্বজন হারানোর বেদনা আমি বুঝি। ঘরবাড়ি হারিয়ে যেসব রোহিঙ্গা এখানে এসেছেন, তারা সাময়িক আশ্রয় পাবেন। আপনারা যাতে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেন,সে ব্যাপারে চেষ্টা চলছে।’- কথাগুলোর মাঝেই নিরীহ রোহিঙ্গাদের জন্য তাঁর মায়া ফুটে ওঠে। ১৯৭৭ সাল থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা ছিলো পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম অত্যাচারিত ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠী। সেনাবাহিনীর জীবনঘাতি আক্রমণ থেকে বাঁচতে মিয়ানমার থেকে উত্তাল সমুদ্র পারি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় এসব রোহিঙ্গা। তাদের অনেকেই সমুদ্রের অতলে হারিয়েছেন নিজেদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, কেউ বা একেবারে নিঃস্ব হয়ে এসেছে এ দেশে৷ তাদের না ছিলো থাকার জায়গা, না ছিলো খাবার। শুধুমাত্র কাচা কলা খেয়ে বেচে থাকার মতো মুহুর্তেরও মুখোমুখি হতে হয় তাদেরকে। ১৯৫১ সালের জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষরিত দেশ হিসেবে না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সবসময় তাদের পাশে ছিলো। “১৬ কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারলে ৭ লাখ মানুষকেও খাবার দিতে পারবো”- উক্তিটির মাঝেই রোহিঙ্গাদের জন্য শেখ হাসিনার মমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো তিনি রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে পারেননি। প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে তিনি অর্জন করেন “মাদার অফ হিউম্যানিটি” উপাধি।
ব্রিটিশ শাসনামলের খপ্পরে পড়ে বাংলা সব হারায়। পরিচিত হয় “দারিদ্র্য” নামক শব্দটির সাথে। স্বাভাবিক জীবনযাপন তো দূরের কথা! ভিক্ষুকের চেয়েও মানবেতর জীবন ছিলো বাঙালিদের। ক্ষমতা গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা পিতার স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেন। অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর থেকে শুরু করে নানামুখী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, দারিদ্র্য ও বৈষম্য হ্রাসে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিধি বৃদ্ধি, ছিন্নমূল- দুঃস্থ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে নানামুখী কর্মসূচী গ্রহণ তারই স্পষ্ট প্রমাণ। এমনকি কোভিড-১৯ এর খরাও খুব দ্রুতই কাটিয়ে উঠেন তিনি। ‘খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২’ অনুযায়ী, বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশ ; যেখানে ২০০০ সালের শুরুর দিকে তার পরিমাণ ছিলো ৪৮.৯ শতাংশ । জরিপটিই প্রমাণ করছে বঙ্গবন্ধু কন্যা দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে গরিব, অসহায়,দুঃস্থ মানুষের পাশে কতটুকু দাঁড়িয়েছেন। তিনি ২৫ বছরে মাতৃ মৃত্যুহার ৪৪৭ থেকে ১৬৩ তে আনেন। তিনি সবসময়ই গরিব, অসহায়,দুঃস্থ মানুষের কথা মাথায় রাখতেন। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১,১৩,৫৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করেন যা মোট বাজেটের ১৬.৭৫ শতাংশ এবং জিডিপির ২.৫৫ শতাংশ। এর মাঝে রয়েছে বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি, বিধবা ভাতা কার্যক্রম, দরিদ্র মায়েদের মাতৃত্বকালীন ভাতা, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহয়তা তহবিল, মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা,অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, এতিমখানার ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট,বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচী,হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম ইত্যাদি। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছর থেকে শুরু হওয়া বয়স্ক ভাতায় যেখানে প্রতি ওয়ার্ডের ৫ জন পুরুষ ও ৫ জন মহিলাকে প্রতিমাসে ১০০ টাকা করে দেওয়া হতো; সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভাতাভোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৭.০১ লক্ষ জন যাদের প্রত্যেকের মাসিক ভাতা ৫০০ টাকা করে। বয়স হয়ে যাওয়ার পর বোঝা হিসেবে গণ্য হওয়া এসব মানুষদের পাশে দাড়িয়ে তাদেরকে সাহস যোগান শেখ হাসিনা। একইভাবে তিনি বিধবা নারীদের কষ্টও লাঘব করেন। সমাজে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হওয়া এসব নারীদের জন্য ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে চালু হওয়া ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা’-র পরিমাণ ১০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকায় এনেছেন এবং ভাতাভোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
মাতৃত্বকালীন সময়টি প্রতিটি নারীর জীবনে এক অন্যরকম অধ্যায়। প্রায় সবসময়ই নিয়মিত একটা ডাক্তারি চেকাপের মধ্যে থাকতে হয় তাদের। পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় তারা অনেকেই ডাক্তারি চেকাপ করাতে পারে না; ফলস্বরূপ অকালমৃত্যু হয় অনেক মায়ের কিংবা অনেক নবপিতা-মাতা হারায় তাদের সন্তানদের। এরই লক্ষ্যে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে প্রথমবারের মত মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান শুরু হয়। কিন্তু এত অল্প পরিমাণ ভাতায় গর্ভবতী মায়েদের তেমন কোনো উপকার হয়নি। তাই মমতাময়ী শেখ হাসিনা ২০২১-২২ অর্থবছরে পুনরায় সে ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি করে ৫০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকায় আনেন। এভাবে তিনি অসংখ্য গর্ভবতী নারীর ভালোবাসা জয় করে নেন। এবারে বলতে বাংলাদেশের সবচেয়ে করুণ একটি দৃশ্যের কথা! দীর্ঘ নয় মাস যাদের অক্লান্ত, নিঃস্বার্থ পরিশ্রমে আমরা আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ ফিরে পেয়েছি, তাদেরই সমাজে কোনো সম্মান ছিলো না। অনেকে বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবারের সন্তানেরা তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যায় কিংবা অনেকের আবার থাকার বাসস্থান না থাকায় রাস্তায় দিনযাপন, এসব ঘটনা যেনো প্রায়ই খবরের চ্যানেলগুলোতে আমাদের নজর কাড়ে। শেখ হাসিনা তাদের পাশেও মানবতার হাত বাড়িয়ে দেন। তিনি ২০২১-২২ অর্থবছরে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা ১২ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকায় উন্নীত করেন। পাশাপাশি আরও কয়েকটি খাতে তাদের জন্য ভাতা নেওয়ার ব্যবস্থা রাখেন। স্বচ্ছলতা ও আলোর মুখ দেখে মুক্তিযোদ্ধারা। ১৯৯৭ সালেই বাংলাদেশের ভূমিহীন, গৃহহীন ও ছিন্নমূল পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আশ্রয় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। তখন গৃহায়ন ঋণ কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী সংস্থা এ তহবিল হতে মাত্র ১.৫ শতাংশ সরল সুদে সর্বোচ্চ ৭ বছর মেয়াদী গৃহনির্মাণ ঋণ বিতরণ করে। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে তিনি ১০,০০০ টি গৃহপ্রদান করেন গৃহহীনদের মাঝে যেখানে তাঁর ঋণের পরিমাণ ১৩০ কোটি টাকা। মানবতার এক অনন্য নজির স্থাপন করেন শেখ হাসিনা। শুধু গৃহপ্রদান করেই চুপ থাকেন নি তিনি, সকলের চাকরির ব্যবস্থাও করে দেন তিনি।
সমাজের উঁচু-নিচু সকল স্তরের মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর অবদানে বেদে, জেলে থেকে শুরু করে হিজড়ারা পর্যন্ত সমাজে মাথা তুলে বেচে থাকার সাহস পেয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে ৯.২৩ লক্ষ টাকা করা হয়। সমাজে মর্যাদা পায় বেদে জনগোষ্ঠী। নদীমাতৃক দেশে জেলেরা প্রধান কর্মজীবী মানুষ হলেও আমাদের দেশে তাদের অবস্থান সবার নিচুতে। অনেক কষ্টের জীবন তাদের। শেখ হাসিনা তাদের জন্যও নির্দিষ্ট একটি ভাতা বরাদ্দ করেন। হিজড়া শব্দটি শুনলেই আমরা কেমন নাক সিটকাই। কিন্তু তারাও তো মানুষ! শেখ হাসিনা তাদেরও নগন্য করে দেখেননি। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তাদের জন্য প্রথম ৭ টি জেলায় উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তাদের সহায়তায় ৫.৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। আলোর মুখ দেখে ৫,৭৪৫ জন হিজড়াসহ সকল হিজড়া। স্বাভাবিক মানুষের মতো তাদের অধিকারের পক্ষে অনেক আইনী লড়াইও করেছেন তিনি।
চা-শ্রমিক, পোশাক শ্রমিকদের জন্যও তিনি কাজ করে গিয়েছেন। তিনি চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে ১৭০ টাকা নির্ধারণ করেন। আনন্দ মিছিলের মাধ্যমে চা শ্রমিক সমাজ শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়। তিনি ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্যও একইভাবে কাজ করেন। জাতীয় স্কেলে বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করেন তিনি। জানা যায়, প্রকল্পের প্রতিটি মসজিদের খতিব জাতীয় বেতন স্কেলের ৮ম গ্রেডে বেতন-ভাতা পাবেন। সে হিসেবে একজন খতিবের মূল বেতন হবে ২৩ হাজার টাকা। গার্মেন্টস শ্রমিকদের অবাসনের লক্ষ্যে তিনি ১২ তলা বিশিষ্ট ভবন তৈরি করা থেকে শুরু করে কোটি টাকার ঋণ প্রকল্প হাতে নেন। তাঁর সবচেয়ে বড় মমতাময়ী অবদান প্রতিবন্ধীদের প্রতি। সমাজের সকল সুবিধাবঞ্চিত শিশু এরা। তাদের না থাকে সকলের সাথে খেলার অধিকার, না থাকে বাঁচার অধিকার। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর তিনি এ বিষয়টিকে এজেন্ডা হিসেবে নিয়েছেন। ২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২রা এপ্রিল অটিজম সচেতনতা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০০৮ সাল থেকে প্রতিবছর পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি এদিন অটিস্টিক শিশুদের সাথে কাটান। তিনি সবসময় তাদের সকল প্রকার সৃজনশীল কাজে উদ্বুদ্ধ করেন। সকল প্রতিষ্ঠানে তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের জন্য ট্রাস্ট গঠন করা,বিভাগীয় পর্যায়ে তাদের বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থা, বিনামূল্যে ফিজিওথেরাপি, ৬৪ জেলায় ১০৩ টি প্রতিবন্ধী সেবাকেন্দ্র স্থাপনসহ তাদের সুবিধার্থে অনেক কাজ করে গিয়েছেন শেখ হাসিনা। এমনকি শুভেচ্ছা কার্ডের ডিজাইনও বেছে নেন অটিস্টিক শিশুদের থেকেই। এ কাজের জন্য পুরো দেশ তথা বিশ্বে তিনি ও তার কন্যা সায়মা হোসেব পুতুল সকলের প্রশংসা কুড়ান।
একজন প্রশাসক হলেও সবার আগে তিনি একজন মা। নিজের ঘরেও দুইটি সন্তান রয়েছে। তাই তো তিনি প্রশাসন ও লাভ ক্ষতির কথা ভাবার পাশাপাশি দেশের অসহায় জনগণের প্রতি সমান গুরুত্বারোপ করেছেন। ঈদের সময় বিকাশের মাধ্যমে ভাতা নেওয়ার সুবিধা চালু করা থেকে শুরু করে সমাজের সকল স্তরের মানুষের স্বার্থে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন মমতাময়ী এ নারী। তাঁর হাত ধরেই অন্ধকার মানবেতর জীবন থেকে পা বাড়িয়ে আলোর জগৎ দেখে পুরো দেশবাসী। তাই “মাদার অফ হিউম্যানিটি” খেতাব বৃথা যায়নি বললেই চলে। এমন মমতাময়ী মা সকলের ঘরে ঘরে থাকুক।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব ও খনি বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।