চারদিনে অবিরাম বর্ষণে নীলফামারীর সৈয়দপুর পৌরসভাসহ উপজেলার সব ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল হাটুপানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। রেকর্ড বৃষ্টিপাতে রেলওয়ে কারখানা সহ শহরের প্রায় সব পাড়া মহল্লার অলিগলি পথ, নিচু বাড়িঘর ও পুকুর ডোবায় থৈ থৈ পানি। আর গ্রামাঞ্চলের ফসলের ক্ষেত তলিয়ে যাওয়াসহ চারপাশে বর্ষার পানি ব্যাপক সমারোহ। অভাবনীয় প্রাকৃতিক দূর্যোগে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সর্বস্তরের জনজীবন।
গত বৃহস্পতিবার থেকে শুর” হয়েছে বৃষ্টি। সেদিন থেমে থেমে হলেও শুক্রবার সকাল থেকে লাগাতার চলছে। শনিবার রাত থেকে রবিবার দুপুর পর্যন্ত তুমুল বর্ষণে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। শহরের প্রাণকেন্দ্র শহীদ ডা. জিকর”ল হক সড়ক, শহীদ ডা. সামসুল হক সড়ক, পৌরসভা সড়কসহ পৌর এলাকার বাঁশবাড়ী, মিস্ত্রীপাড়া, হাতিখানা, নিচু কলোনী, মুন্সিপাড়া, কয়ানিজপাড়া, নয়াটোলা, গোলাহাট, নিয়ামতপুর জুম্মাপাড়া, কাজিপাড়া, নতুন বাবুপাড়ার, সাহেবপাড়া, ইসলামবাগ, রসুলপুর, রাস্তাগুলো পানির নিচে।
এসব এলাকার অনেক বাড়ি ঘর, দোকান, গোডাউনে পানি ঢুকে পড়েছে। এতে জলাবদ্ধতার শিকার পুরো পৌরবাসী। বাড়ির আসবাবপত্র, দোকানের মালামাল পানিতে ভিজে নষ্ট হওয়ার উপক্রম। বাজারে কাঁচামাল পঁচে যাওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে। এতে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। একদিকে পানিবদ্ধতা, অন্যদিকে উপার্জনহীন। তার উপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে নিম্ন আয়ের মানুষ চরম সমস্যায় পড়েছেন। শহরের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ রয়েছে এবং পানিবন্দি মানুষ চুলা জ্বালাতে না পেরে অনাহারে রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও বৃষ্টির পানির আধিক্যের ফলে নিম্নাঞ্চলসহ অনেক উঁচু এলাকাতেও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ধানের ক্ষেত, পুকুর পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও পানির স্রোতের চাপে রাস্তা ভেঙে গেছে। সবজির ক্ষেত নষ্ট হওয়া সহ পুকুর ডুবে মাছ বেরিয়ে গেছে। নিচু বাড়ি ঘরেও পানি ঢুকে পড়েছে। ফলে হাজার হাজার মানুষ পানিতে আবদ্ধ অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। খেটে খাওয়া হতদরিদ্র দিনমজুর মানুষেরা আয় করতে না পেয়ে না খেয়ে আছেন।
পৌরবাসীর অভিযোগ ড্রেনেজ ব্যবস্থা অচল হওয়ায় পানি বের হতে পারছেনা। একারণে সামান্য বৃষ্টিতেই শহরে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। সেখানে এত বর্ষণে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পৌর কর্তৃপক্ষের অসচেতনা ও অব্যবস্থাপনার কারণেই সৈয়দপুরের এই দূরাবস্থা। পরিকল্পিতভাবে ধারাবাহিকতার সাথে অচল ড্রেন মেরামত, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নতুন ড্রেন নির্মাণ ও নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার করলে এই দুর্ভোগ পোহাতে হতনা।
তাদের মন্তব্য হলো প্রতিবছর এমন শোচনীয় অবস্থা দেখা দিলেও নাগরিকদের কষ্ট লাঘবে জনপ্রতিনিধিদের কোন উদ্যোগ নেই। এতে কিছু কিছু এলাকায় শুকনা মৌসুমেও রাস্তায় পানি জমে থাকে। আর বৃষ্টি হলে ড্রেন উপচে পানিসহ নোংরা ময়লা আবর্জনা ঢুকে পড়ে বাসায়। জমা পানিতে মশার উৎপাদন বাড়ায় উৎপাতও বেড়েছে। এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দুঃসহ যন্ত্রণায় বছরের পর বছর কাটছে এলাকাবাসীর।
সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্বাবধায়ক (ডিএসডাব্লিউ) সাদেকুর রহমান বলেন, অতিবৃষ্টিতে কারখানার কয়েকটি সপে (উপ-কারখানা) পানি জমেছে। এতে কাজে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। সেই সাথে বিদ্যুৎ না থাকায় সপগুলো বন্ধ রয়েছে। পার্বতীপুর ক্যারেজ লোকোমেটিভ কারখানায়ও (কেলোকা) একই অবস্থা। পানি নিষ্কাশনের জন্য সৈয়দপুর পৌরসভার ড্রেনেজ ব্যবস্থা কার্যকর না হওয়ায় এমন পানিবদ্ধতার সমস্যা বলে মন্তব্য করেন তিনি। এক্ষেত্রে দ্র”ত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তিনি পৌর কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
এবিষয়ে জানতে সৈয়দপুর পৌরসভার মেয়র রাফিকা আকতার জাহান বেবীর সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, বৃষ্টি প্রাকৃতিক ব্যাপার। এটা আটকানো বা হওয়ার পর পানি সরানোর কোন ব্যবস্থা মানুষের হাতে নেই। শহরের ডোবা তথা জলাধারগুলো দখল ও ভরাট হওয়ায় পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এব্যাপারে আমরা পরিষদগতভাবে উদ্যোগ নিয়েছি। তবে জনগণের অসহযোগিতার কারণে সফল হতে পারিনি। আগামীতে এদিকটাই গুর”ত্বের সাথে দেখা হবে। আর আমি বর্তমানে ঢাকায় জর”রী মিটিংয়ে ব্যস্ত আছি।
সৈয়দপুর রাজনৈতিক জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক অধ্যক্ষ আলহাজ্ব আব্দুল গফুর সরকার বলেন, নৌকার মেয়র তার সরকারের মতই লুটপাট নিয়ে ব্যস্ত। নিজের আখের গোছানোয় সচেষ্ট থাকলেও জনগণের ভোগান্তি লাঘবে তাঁর কোন ভূর”ক্ষেপ নাই। বিগত সাড়ে তিন বছরে পৌরসভার উল্লেখযোগ্য কোন উন্নয়ন কাজ করা হয়নি। ড্রেনেজের অচলাবস্থায় পানিবন্দি হওয়া সৈয়দপুরবাসীর চির দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, সাবেক এমপি ও পৌর মেয়র জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মরহুম আমজাদ হোসেন সরকার মেয়র থাকাকালে এমন দূর্যোগের সময় শহরব্যাপী ব্যাপক সহায়তা কার্যক্রম চালানো হতো। যাতে লোকজন কষ্ট না পায়। অথচ আজকে মেয়ের সৈয়দপুরেই নেই। পৌর পরিষদের অন্যান্য সদস্যরাও নির্বিকার। আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে শুকনো খাবার ও অন্যান্য ত্রাণ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছি।
সৈয়দপুর উপজেলা জামায়াতের আমীর ও কেন্দ্রীয় মজলিসের সুরা সদস্য, হাফেজ মাওলানা আব্দুল মুনতাকিম বলেন, এ দূর্যোগে যারা পানি বন্দী হয়ে পড়েছে তাদের পাশে বৃত্তবানদেনর দাড়ানো আহবান জানান। তিনি বলেন পৌর এলাকায়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থা খুবই নগ্ন এবং যে সকল ড্রেন নির্মান করা হয়েছে সে গুলো পয়নিস্কাশনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং অল্প বৃষ্টিতে সৈয়দপুর তলিয়ে যায়। জনপ্রতিনিধিদের যেহেতু এদিকে ভূর”ক্ষেপ নাই, তাই এনিয়ে কথা বলেও কোন কাজ হবেনা। সেজন্য কথা না হবে কাজে নেমেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে শহর শাখার উদ্যোগে পানিবন্দি মানুষের মাঝে শুকনা খাবার বিতরণ শুর” করেছি। পৌরসভার ২, ৩, ৬, ১৪, ১৫ নং ওয়ার্ডে আমাদের খাদ্য পৌঁছিয়েছি। অন্যান্য ওয়ার্ডে ও উপজেলা শাখার পক্ষ থেকে সব ইউনিয়নে দেয়া হবে। জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও সংগঠনের দিকে চেয়ে না থেকে প্রতিটি এলাকার সামর্থবান মানুষদের নিজ নিজ উদ্যোগে আশেপাশের সংকটাপন্নদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
বিদ্যমান সমস্যা নিয়ে কথা হয় সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোখছেদুল মোমিনের সাথে। তিনি বলেন, তীব্র তবিদ্যমান সমস্যা নিয়ে কথা হয় সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোখছেদুল মোমিনের সাথে। তিনি বলেন, তীব্র তাপদাহের পর এট আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি শুর” হয়েছে। তপ্ত মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। তবে অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে শহর ও গ্রামাঞ্চলে কিছু কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে মানুষ কষ্টে পড়েছে। এমতাবস্থায় বৃষ্টি থামানোর কোনো পথ নাই।
কিন্তু সংকটাপন্ন লোকজনের জন্য সহযোগিতা করা প্রয়োজন। এজন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে পানিবন্দি মানুষের মাঝে শুকনা খাবার ১৫০০ পরিবারের মাঝে বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছি। উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ত্রাণ প্রদানের জন্য ইউএনও এর সাথে পরামর্শক্রমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পৌর এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসন বা ড্রেনেজ অচলাবস্থা নিয়ে তিনি কোন মন্তব্য করতে চাননি এবং রাতেই ইউনিয়ন গুলোতে পানিবন্দী মানুষের মাঝে শুকনা খাবার বা খাদ্য বিতরণ করা হবে।