অন্যের গোয়াল ঘরের এক কোণে আশ্রিত হয়ে গরুর সাথে বসবাস করছে এক ভিক্ষুক দম্পতি। দীর্ঘ ৮ বছর যাবত বাক প্রতিবন্ধী স্ত্রীকে নিয়ে এমন মানবেতর জীবন যাপন করলেও সোলেমান মৃধার ভাগ্যে জুটেনি সরকারী আশ্রয়ণের একটি ঘর। বার বার আবেদন করে নানাজনের কাছে ধর্ণা দিলেও কারো দয়া হয়নি এই ভূমিহীন অসহায় দুস্থ মানুষ দুটির প্রতি। সুবিধা ভোগের উপযুক্ত হয়েও নিজস্ব মাথা গোজার ঠাই না পেয়ে চরম হতাশা আর আক্ষেপ নিয়ে দিন যাপন করছেন। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটলেও মৃত্যুর আগে তাদের এ আশা পূরণ হবে কি না তা ভেবেই বেশি কষ্ট। অশ্রুসিক্ত নয়নে আর আবেগাপ্লুত কন্ঠে সেই আশা নিরাশার দোলাচলের কথাই জানালেন দুঃখভরা ভাষায়।
লোকমুখে এমন অসহায়ত্বের কথা জেনে বৃহস্পতিবার (১৭আগস্ট) সকাল ১০ টায় নীলফামারীর সৈয়দপুর পৌরসভাধীন ১৩ নং ওয়ার্ডের সাহেবপাড়া গফুর বস্তি এলাকায় সরেজমিনে উপস্থিত হই দুইজন সংবাদকর্মী। রেলওয়ে কারখানার গেট বাজারের উত্তরপ্রান্তে পৌরসভার পাবলিক টয়লেট ঘেষে একটি ঝুপড়ি ঘর। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই দেখা মেলে একগাদা গোবর। পাশেই দাঁড়িয়ে দুইটি গরু। গরু ও গোবর পেরিয়ে সামনে এগুতেই চোখে পড়ে স্যাঁতসেঁতে মাটিতে বসে চুলা জ্বালিয়ে রান্নারত এক নারী। ভিক্ষুক সোলেমান মৃধার বাক প্রতিবন্ধী স্ত্রী মাহমুদা বেগম।
মাত্র ৩ হাত চওড়া আর ৫ হাত লম্বা জায়গাতেই একটা খুটা (বাঁশের তৈরী চৌকি), একটা নড়বড়ে টেবিল, চুলা, হাড়ি পাতিল, থালাবাসন, মরচেধরা একটা ট্রাংক আর দড়িতে ঝুলানো কিছু কাপড়-চোপড় নিয়ে ভিক্ষুক দম্পতির ছোট সংসার। এর মধ্যেই আবার গরুর খাবার ঘাস, খড়, ভূষিও রাখা। ঘিঞ্জি হলেও বেশ পরিপাটি। তবে চরম অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় গরু-মানুষের একসাথে বসবাস। মাথার উপরের টিন আর বেড়াও ভাঙ্গাচোরা। সূরে্যর আলো আর তাপ সরাসরি প্রবেশ করে ঘরের আবহাওয়া গুমোট করে তুলেছে। গরুর মল-মূত্রের গন্ধে নাভিশ্বাস অবস্থা। দুদ-টেকা দায়।
ভ্র কুঁচকে নাক চেপে ধরা দেখে সোলেমান মৃধা কষ্টের হাসি দিয়ে বলেন, এমন অস্বস্তিকর পরিবেশে সামান্য কয়েক মিনিটেই আপনাদের দম আটকানোর মত। অথচ আমরা এই দুইটা মানুষ বছরের পর বছর ধরে এখানে থাকছি। শীতে ভাঙা বেড়া দিয়ে ঠান্ডা ঢোকে আর বর্ষায় চালের টিনের ফুটা দিয়ে ধর ধর পানি পড়ে। মেঝে, বিছানা পানিতে একাকার হয়ে গরুর গবর কাদায় মাখামাখি করে কাটে দিনরাত। দিনের পর এভাবে মানবেতর জীবন যাপনেও কেউ কখনই ফিরে দেখেনি। সামান্য সাহায্যের হাতও বাড়ায়নি। সারাদিন মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ক্লান্ত দেহ নিয়ে ঘরে এসে এতটুকু স্বস্তি পাইনা এমন দূর্বিসহ পরিস্থিতিতে।
অশ্রু ভেজা নয়নে দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে তিনি আরও বলেন, আমার বাবা আব্দুল জব্বার মৃধা আদি নিবাস ফরিদপুর থেকে পাকিস্তান আমলে ব্যবসায়ীক সূত্রে সৈয়দপুরে এসে বসবাস করতে থাকেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি এখানেই শহীদ হন। সেই সুবাদে তখন থেকেই সৈয়দপুরে আমার অবস্থান। কালের পরিক্রমায় সার্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করছি। দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ ধরে এভাবেই বেঁচে আছি। আট বছর হলো ঠাঁই হয়েছে এই গোয়ালঘরে। প্রতিবন্ধী স্ত্রী কে নিয়ে গরুর সাথে একঘরে বাস করছি। মুরগী ব্যবসায়ী কাশেম ভাই দয়া করে এটুকু দিয়েছে বলে মাথা গোজার সুযোগ হয়েছে। নয়তো অনেকদিন রেলস্টেশনের প্লাটফরমে কেটেছে।
এখন শেষ বয়সে এসে এভাবে আর পারছিনা। মৃত্যুর আগে যদি নিজের একটা ঘর হতো তাহলে শান্তিতে মরতে পারতাম। কিন্তু সাধ্যতো নাই। আমার মত অনেক গৃহহীন মানুষ আশ্রয়ণে বা সরকারী আবাসনে ঘর পেয়েছে। আমিও সেই আশাতেই সরকারী আশ্রয়ণে ঘর পেতে পর পর চার বার আবেদন করেছি। কিন্তু পাইনি। কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান, ইউএনও এর কাছে ধর্ণা দিয়েও মেলেনি ঘর। এমতাবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। দয়া করে আমার মত অসহায়, দুস্থ, নিরীহ এবং আমার স্ত্রীর মত প্রতিবন্ধীর জন্য একটা ঘর বরাদ্দ দেন। যেন শহীদের সন্তান হয়ে জীবনের বাকি দিনগুলো আপন নীড়ে থাকার ভাগ্য হয়।
এসময় সোলেমান মৃধার প্রতিবন্ধী স্ত্রী মাহমুদা ইশারায় তার আকুতি তুলে ধরেন। টেনে নিয়ে তাদের দূরাবস্থা দেখিয়ে অশ্রুতে বুক ভাসান। অব্যক্ত কষ্ট ব্যক্ত করতে অস্পষ্ট ভোঙ্গানীতে বার বার দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রয়াস চালান। তার ভাবাবেগ দেখে যে কেউ মূহুর্তের জন্য স্তম্ভিত ও মানবতা বোধে শিহরিত হতে বাধ্য। আশেপাশের লোকজনও তখন তাদের জন্য অনুরোধ জানান।
পৌরসভার ১৩ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সৈয়দ মঞ্জুর আলম বলেন, সোলেমান মৃধাকে আমি চিনি, জানি। তিনি অত্যন্ত কষ্ট করে অন্যের ঘরে থাকেন। ভিক্ষা করে সংসার চালায়। তার স্ত্রী প্রতিবন্ধী। অত্যন্ত মানবেতর অবস্থায় আছেন। তিনি আশ্রয়ণের ঘর পাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। আমার কাছে স্বাক্ষর নিয়ে তিনি অনেকবার আবেদন করেছেন। অথচ আজও তার ভাগ্যে জুটেনি। এটা খুবই দুঃখজনক। আমি তাকে একটি সরকারী ঘর প্রদানের বিনীত আবেদন জানাচ্ছি উপজেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি।
সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফয়সাল রায়হান বলেন, সোলেমান মৃধা ও তার স্ত্রী সম্পর্কে আমার জানা নাই। এমন কেউ আবেদন নিয়ে বা এমনিতেও আমার কাছে আসেনি। তবে এখন যে বর্ণনা শুনলাম এবং যদি আবেদন করে থাকে তাহলে তাদেরকে ঘর দেয়া খুবই জরুরী। তাদেরকে অবশ্যই আমার কাছে পাঠিয়ে দিবেন। পর্যাক্রমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার আশ্রয়ণের ঘর যাচাই বাচাই এর পর অবশ্যই উপহারের ঘর বরাদ্দ দেয়া হবে।