নীলফামারীতে গরুর লাম্পি স্কিন রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। ভাইরাসজতিন এ রোগে জেলায় আক্রান্ত হয়েছে প্রায় পাঁচ সহস্রাধিক গরু। বিচ্ছিন্নভাবে এ রোগে গরু মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগে মৃত্যুর কোনো তথ্য নেই।
রোগ সারাতে গরু পালনকারীরা অনেকেই চিকিৎসা করাচ্ছেন স্থানীয়ভাবে। আবার কেউ কেউ গরু নিয়ে যাচ্ছেন উপজেলা ও জেলা প্রাণি সম্পদ কার্যালয়ে।
গরু পালনকারীরা বলছেন, হঠাৎ করে গরুর গায়ে জ্বর দেখা দিচ্ছে। এরপর শরীরজুড়ে ছোটবড় গুটি আকারে ফুলে উঠে চামড়ায় ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে। আক্রান্ত গরু খাদ্য কম খাচ্ছে।
তবে প্রাণি সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন রোগটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। এ রোগ চিকিৎসায় ভালো হয়ে যায়।
শনিবার দুপুরে কথা হয় জেলার জলঢাকা উপজেলার বালাগ্রাম ইউনিয়নের শালনগ্রামের গরু পালনকারী ধনেশ^রী বর্মনীর (৮০) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘গরু হামার ৪টা, আগত দুইটার জ¦র হইল, হয়া খালি কম হইছে, কাইল ফির আরেকটার ধইরছে। গরু গিলা কিছুই খায়ছে না। খালি ঠ্যাং ঝড়েছে। বিয়ানে এনা পোয়াল টানিল, এলা ওটাও টানে না। গ্রামের কবিরাজ দিয়া চিকিৎসা করেছি। গরুগিলা নিয়া হামরা খিব চিন্তাত আছি।’
একই গ্রামের কৃষক ভোলানাথ রায় (৫০) বলেন, ‘আমার একটা বলদ আর একটা গাভী ১০/১২দিন থেকে ভুগতেছে। গ্রামের পশু চিকিৎৎসক দিয়ে চিকিৎসা করে এখন একটু সুস্থ্য আছে।’ তিনি বলেন, ‘গ্রামের প্রায় প্রতিটি কৃষকের গরু ল্যাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।’
শালনগ্রামের কৃষক মেহেদী হাসান (৪৫) বলেন, ‘আমার সাতটা গরু র্যাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হয়। ১৫দিন আগে একটা এবং ৭দিন আগে আরো একটা গরু মারা গেছে। এখন আক্রান্ত আছে ৫টা গরু। স্থানীয় গ্রাম্য পশু চিকিৎসক দিয়ে গরুগুলোর চিকিৎসা করাচ্ছি।’
কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাহাগিলি ইউনিয়নের উত্তর দুরাকুটি পশ্চিমপাড়া গ্রামের গরু খামারী রবিউল ইসলাম (৪৫) বলেন, ‘আমার একটি বিদেশি জাতের গরু কয়েকদিন আগে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। প্রথমে গরুটির প্রচন্ড জ্বর হয়। তাঁরপর সমস্ত শরীরের নিচে ফোসকা ও গুটি গুটি আকার ধারন করে। এক পর্যায়ে গরু খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়ে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে শুক্রবার মারা গেছে। আমার গরুটির আনুমানিক মুল্য ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। অনেক চিকিৎসা করেও আমি গরুটি বাঁচাতে পারিনি।’ওই গ্রামে ভাইরাসে আক্লান্ত হয়ে কালা মিয়ার একটি ও দিনমজুর অলিয়ার রহমানের একটি গরু মারা গেছে বলে জানান তিনি।
পুটিমারী ইউনিয়নের কৃষক সাজেদুল ইসলাম (৪০) বলেন, ‘ দুইদিন থেকে ভ্যানে করে অসুস্থ্য গরু নিয়ে কিশোরগঞ্জ উপজেলা প্রাণি সম্পদ কার্যালয়ে চিকিৎসার জন্য আসছি, কিন্তু কোনো ফল পাচ্ছি না। উল্টো ভ্যান ভাড়া ও চিকিৎসা বাবদ ব্যায় হচ্ছে। সরকারিভাবে কোনো ওষুধ দেওয়া হচ্ছে না। ডাক্তার গরুর জন্য ওষুধ লিখে দেন, ওই ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়।’
এ বিষয়ে কথা বললে কিশোরগঞ্জ উপজেলা ভ্যাটেনারী সার্জন মো. নাহিদ সুলতান বলেন, ‘এই রোগটি মোকাবেলা করতে হলে প্রথমে অসুস্থ্য গরু থেকে সুস্থ্য গরু আলাদা রাখতে হবে। উপযুক্ত ক্ষেত্রে মশারী ব্যবহারসহ গরু রাখার জায়গা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।’
কিশোরগঞ্জ উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা নুরুল আজিজের কাছে এই রোগে উপজেলায় কতগুলো গরুর মৃত্যু হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই রোগে গরু মুত্যুর বিষয়ে কোনো তথ্য আমার জানা নেই।’ তবে তিনি ভাইরাস আক্রান্তের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘রোগটি প্রতিরোধে বিভিন্ন এলাকায় লিপলেট বিতরনসহ বিভিন্ন কর্মকান্ড অব্যহত আছে। আক্রান্ত গরু নিয়ে গরু মালিকরা চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসছেন, তবে পরিমানে বেশি নয়।’
ডোমার উপজেলার জোড়াবাড়ি ইউনিয়নের মিরজাগঞ্জ গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য মফিজুল ইসলাম (৫৫) বলেন,‘গ্রামে ব্যাপক হারে গরুর চামড়া ফুটা হওয়া রোগ (লাম্পি স্কিন ডিজিজ) ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা করাচ্ছেন। গত দুই সপ্তাহে গ্রামে পাঁচটি গরুর মৃত্যুর খবর জেনেছি’।
প্রাণি সম্পদ বিভাগের দেয়া এক তথ্যে জানা যায়, এর আগে আমাদের দেশে লাম্পি স্কিন ডিজিজের (এলএসডি) ব্যাপকতা ছিল না। ২০২০ সালে প্রথমবার ব্যাপকতা দেখা যায়। এরপর ২০২১ সালে কমে যাওয়ার পর ২০২২ সাল থেকে আবার দেখা দেয়। এ রোগে সাধারণত বাছুর গরু আক্রান্ত হচ্ছে। চিকিৎসা করলে চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে সেরে উঠে। গরুর গায়ে জ্বর, গুটি আকারে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফুলে ওঠা, গলার নিচে এবং সিনার কাছে পানি জমে ফুলে উঠা এবং স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে খাদ্য কম গ্রহন করা এ রোগের লক্ষণ। মশা, মাছির মাধ্যমে এ রোগটি ছড়ায়। এজন্য খামার বা বাড়ির আশপাশ পরিস্কার রাখা, অসুস্থ্য গরুটি আলাদা করা এবং আক্রান্ত গরুটি মশা, মাছি থেকে দূরে রাখতে মশারী ব্যবহার করার পরামর্শ প্রাণি সম্পদ বিভাগের। ১০ লিটার পানিতে পাঁচ চামুচ খাবার সোডা মিশিয়ে খামার বা গরু রাখার স্থান এবং আশপাশ এলাকা স্প্রে করা অথবা গরুর খাওয়ার পানিতে দুই থেকে তিন চামুচ খাবার সোডা মিশিয়ে সে পানি গরুকে পান করালে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
এ বিষয়ে জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা মো. মোনাক্কা আলী বলেন,‘ জেলার কিছু কিছু এলাকায় এ রোগ দেখা দিয়েছে। এটি ভাইরাস জনিত রোগ। আমরা অসুস্থ্য গরুগুলোকে সুস্থ্য গরুগুলো থেকে আলাদা রাখার পরামর্শ দিচ্ছি। এ রোগে বেশি চিকিৎসা লাগে না। প্যারাসিটামল বড়ি, খাওয়ার সোডা পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত গরুকে খাওয়াতে বলছি। নিম পাতার রস এর প্রতিশেধক। জেলার সব উপজেলায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব আছে। চিকিৎসায় এ রোগ নিরাময় হয়। গরু মারা যাওয়ার কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।