ইসলাম পূর্ণাঙ্গ একটি জীবনবিধান, যা মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষকে দিকনির্দেশনা দেয়। আর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র হলো উত্তরাধিকার। শ্বাশত ধর্ম ইসলাম উত্তরাধিকার বণ্টনের ন্যায়ভিত্তিক ও সামগ্রিক মূলনীতি প্রণয়ন করেছে, যাতে মৃত ব্যক্তির স্বজনরা প্রত্যেকেই তার অধিকার পূর্ণরূপে লাভ করতে পারে এবং সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা হয়। ইসলামের প্রধানতম দুই উৎস পবিত্র কোরআন ও হাদিসে উত্তরাধিকার ও সম্পদ বণ্টনের বিধান সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে নিষেধ করা হয়েছে ওই বিধান পরিবর্তন এবং তার প্রতি গাফলতির বিষয়েও।
ইসলাম উত্তরাধিকারকে কতটা গুরুত্ব দেয়, এটা বোঝা যায় পবিত্র কোরআনে এর মূলনীতির বিশদ বর্ণনার মাধ্যমে। উত্তরাধিকার এমন একটি অধিকার যা মৃত ব্যক্তির স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ তার স্বজনদের মধ্যে বণ্টনের কথা বলে। যাতে স্বজনদের কেউ বঞ্চিত না হয় এবং তাদের মধ্যে ন্যায় ও ইনসাফ কায়েম থাকে। ইসলামি উত্তরাধিকার ব্যবস্থা সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং পারিবারিক সৌহার্দ্য ও ভালোবাসা সৃষ্টি করে। ইসলাম প্রত্যেককে তার ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করেছে এবং কারও অধিকার ক্ষুণ্ন করা অথবা অন্যায় বণ্টনকে বিরাট পাপ আখ্যায়িত করেছে।
পবিত্র কোরআনে সুরা নিসার মধ্যে উত্তরাধিকার ও সম্পদ বণ্টনের বিধানাবলি বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে মা-বাবা, সন্তান-সন্ততি ও স্বামী-স্ত্রীর বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে পৃথক পৃথক মূলনীতি। যাতে স্বজনদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা হয়।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তান-সন্ততির (অংশ) সম্পর্কে নির্দেশ দিচ্ছেন, পুরুষ দুই নারীর অংশের সমান পাবে, তবে সন্তান যদি দুজন নারীর বেশি হয়, তাহলে তারা রেখে যাওয়া সম্পত্তির তিন ভাগের দুভাগ পাবে…।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ১১) এই আয়াতে মহান আল্লাহ উত্তরাধিকার বণ্টনের মূলনীতি বর্ণনা করেছেন। এ অনুযায়ী ছেলে ও মেয়ে উভয়কে তাদের অংশ দেওয়া হবে। এই বিধান আল্লাহর তরফ থেকে নির্ধারিত এবং এর মধ্যে কোনও প্রকার কমবেশি করার সুযোগ নেই।
হাদিস শরিফেও আল্লাহর রাসুল (সা.) উত্তরাধিকার বণ্টনের বিষয়ে স্পষ্টভাবে মূলনীতিগুলো বর্ণনা করেছেন। হজরত সা’আদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি খুব অসুস্থ ছিলেন। তখন রাসুল (সা.) তাকে দেখতে গেলেন। এ সময় সা’আদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রাসুলকে (সা.) জানালেন, তিনি তার সমুদয় সম্পত্তি সদকা করতে চান। তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) তাকে এর থেকে নিষেধ করলেন এবং বললেন, তোমার সম্পদের এক তৃতীয়াংশের বেশি দান করো না; বরং এটিই বেশি। (সহি বুখারি)
এই হাদিসটিতে এই মূলনীতি বর্ণনা করা হলো যে, যারা উত্তরাধিকারের অধিকারী তাদের নিজেদের অংশ দিতে হবে এবং মৃত ব্যক্তি যদি তার সব মালও সদকা করার ওসিয়ত করে যায়, তাহলে তার এক-তৃতীয়াংশ সদকা করা যাবে।
আমাদের সমাজের অনেকে বিয়ের খরচকে বাহানা বানিয়ে মেয়ে ও বোনদের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করে। শরিয়তে এটা সম্পূর্ণরূপে নাজায়েজ। ইসলামি শিক্ষা হলো, বাবা-মা কিংবা বাবার মৃত্যুর পর বোনদের বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব ভাইদের ওপর বর্তাবে। সুতরাং বিয়েতে খরচ করার মানে এটা নয় যে, মেয়ে ও বোনের উত্তারাধিকারের অধিকার শেষ হয়ে গেলো। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে সর্বাবস্থায় উত্তরাধিকারের অধিকার সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ইসলামি উত্তরাধিকার আইনে ন্যায্যতা নিশ্চিত করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতি রয়েছে। যেমন-
১. নিকটাত্মীয়দের অধিকার। সর্বপ্রথম নিকটাত্মীয়দের অধিকার নির্ধারিত হয়। যেমন: বাবা-মা, সন্তান ও স্বামী-স্ত্রী।
২. পুরুষ ও নারীর অংশ। ছেলে ও মেয়ে উভয়কে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে অংশ দেওয়া হয়েছে। পুরুষের অংশ হয় নারীর দ্বিগুণ। কারণ স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়-স্বজনের দায়িত্ব পুরুষের ওপর বর্তায়।
৩. ওসিয়তের অংশ। মৃত ব্যক্তি তার সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ যেকোনও খাতে দান-সদকার ওসিয়ত করে যেতে পারেন। কিন্তু বাকি দুই অংশ শরিয়তের আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে।
৪. এতিম ও অসহায়-দুর্বলদের রক্ষণাবেক্ষণ। ইসলাম এতিম ও দুর্বলদের অধিকার সংরক্ষণে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। যাতে তারা বঞ্চিত না হয়।
ইসলামি সমাজে উত্তরাধিকার বণ্টনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। মহান আল্লাহ কোরআনে বলেন, ‘এগুলো আল্লাহর সীমারেখা। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে আল্লাহ তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতসমূহে, যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর এটা মহা সফলতা।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ১৩)
আল্লাহ এই আয়াতে উত্তরাধিকারকে ‘সীমারেখা’ আখ্যায়িত করেছেন। সীমারেখার মধ্যে থাকলে যেমন তিনি জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। ঠিক তেমনই কেউ যদি এই সীমারেখা অতিক্রম করে, তার জন্য এর পরের আয়াতেই আল্লাহ তায়ালা কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নাফরমানি করে এবং তাঁর সীমারেখা লঙ্ঘন করে আল্লাহ তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন। সেখানে সে স্থায়ী হবে। আর তার জন্যই রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ১৪)।